পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brᏬ জগদিন্দ্ৰ-বিয়োগে সংসারে পরিচয় হয় অনেকেরই সঙ্গে, কিন্তু অধিকাংশ স্থলেই সেই পরিচয়ের কোঠা পার হইয়া ভিতরের মহলে প্রবেশ করা ঘটিয়া উঠে না। সহজে আত্মীয়তা করিবার শক্তি দূর্লভ শক্তি, জগদিন্দ্রনাথের সেই শক্তি ছিল। শ্রদ্ধা অনেক লোককে করা যায়, অসামান্য গুণের জন্য অনেককে প্রশংসাও করিয়া থাকি কিন্তু তবু আপনি বলিয়া মানিতে পারি না। মৃত্যুর আকস্মিক আঘাতে যে বন্ধুকে আজ হারাইয়াছি, তাহার সম্বন্ধে এই কথাটাই মনে সবচেয়ে বড়ো করিয়া জাগিয়া উঠিতেছে যে, প্রথম পরিচয় হইতেই আত্নীয় হইয়া উঠিতে র্তাহার বিলম্ব হয় নাই, এবং সম্পূর্ণই সে তাহার নিজগুণে। তখন লোকেন্দ্রনাথ পালিত ছিলেন রাজসাহির ম্যাজিষ্ট্রেট, আমি তাহার অতিথি। তখন সাধনা পত্রিকার বুলি প্রতিমাসেই আমাকে নানাবিধ রচনা দিয়া ভরিয়া দিতে হইত। ম্যাজিষ্ট্রেটের নির্জন বাংলায় আমার সমস্ত দিন সেই কাজেই পূর্ণ ছিল। লোকেন। কাছারি হইতে ফিরিলে পর সন্ধ্যার সময় বৈঠক বসিত। সেই বৈঠকে আভিজাত্যের লবণ্যে উদ্ভাসিতীমূর্তি যুবক জগদিন্দ্রনাথ প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তঁহাকে প্রধান যে বলিলাম সেটা নিজের প্রতি কপট বিনয় করিয়া নহে। নিকুঞ্জে বসন্ত উৎসবের যে আসর বসে, সে আসরের প্রধান নায়ক পুষ্পিত শাখা নহে, দক্ষিণ সমীরণ । জগদিন্দ্রনাথের চিত্তের মধ্যে চিরপ্রবাহিত যে দক্ষিণ্য ছিল তাঁহারই স্পর্শে আমাদের মন ভরিয়া উঠিত। সে বৈঠকে আমরা দিতাম উপকরণ তিনি দিতেন নিজেকে। তিনিই সভা জমাইতেন। মনে পড়ে, কবিতা পড়িয়া, গান গাহিয়া, গল্প শুনাইয়া রাত্ৰি প্ৰায় শেষ হইয়া গেছে। এই অক্লাস্ত মজলিশের উৎসাহ তিনিই জোগাইয়াছেন। তাহার রসবোধের প্রচুর আনন্দই রসের ধারাকে আকর্ষণ করিয়া আনিত। আমি তখন যৌবনের সীমা পার হই নাই, রচনার ঔৎসুক্যে আমরা মন তখন পুলকিত, সেই সময়ে এই রসরাগরঞ্জিত যুবকের সহিত আমার প্রথম পরিচয়। তার পর নাটাের হইতে যখন তিনি কলিকাতায় আসিয়া বসিলেন, তখন তাঁহারই অনুপ্রাণনায় কলিকাতায় আমাদের বাড়িতে সপ্তাহে সপ্তাহে এক সান্ধ্য বৈঠক জমিয়া উঠিল, তাহার নাম ছিল ‘খাম খেয়ালি”। তখন আমি আপন খেয়ালমতো সুরে লয়ে গান রচিতে প্ৰবৃত্ত ছিলাম। আমাদের দেশে যাহাকে ক্লাসিকাল সংগীত বলা যাইতে পারে, সেই হিন্দুস্থানী সুরে তালে জগদিন্দ্রনাথ পারদর্শী ছিলেন। আমি ছিলাম স্বভাবতই বড়ো বেশি আধুনিক, বিদ্রোহী বলিলেই হয়। গানের নামে আমি রাগ-রাগিণী ও বাধা তালের ছাঁচে ঢালা নমুনা দেখাইবার দিকে মন দিই নাই- এমন অবস্থাতেও জগদিন্দ্রনাথ গান সম্বন্ধে আমাকে একঘরে করিলেন না। আমার গান তাহার শিক্ষা ও অভ্যাসের বিরুদ্ধ হইলেও তাঁহার রুচিবিরুদ্ধ হয় নাই। তিনি অকৃত্ৰিম আনন্দের সহিত তাহার রস উপভোগ করিতেন। কি সাহিত্যে কি সংগীতে র্তাহার মনের মধ্যে ভারি একটি দরদ ছিল— বাঁধা দস্তুরের শিক্ষা কসরতে তাহার কোনাে অংশে একটুও কড়া পড়িয়া যায় নাই। তাই খাম-খেয়ালির আসরে তিনি আপন আসনটি এমন পুরাপুরি দখল করিতে পারিয়াছিলেন। সে সময়ে আমার নিজের নির্জন আসন ছিল পদ্মাতীরে বালুতটে। সেখানেও কিছুদিন সঙ্গ-বিরলতা অত্যন্ত শূন্য ঠেকিবার কথা; কিন্তু জগদিন্দ্র সেখানকার নিভৃত প্রকৃতির আমন্ত্রণ হইতে বঞ্চিত হন নাই; সেখানকার জল স্থল আকাশের সুরের সঙ্গে তাহার মনের মধ্যে সঙ্গৎ জমিয়াছিল, তাল কাটে নাই। জগদিন্দ্ৰনাথ আমার এই নির্জন আতিথ্যের জবাব দিয়াছিলেন বিশাল জনসংঘের মধ্যে। যে বৎসর নাটােরে প্রাদেশিক রাষ্ট্ৰীয় সম্মিলনীর সভা বসিল, সেবার তাহার আহবানে খামখেয়ালির প্রায় সকলেই তাহার ঘরে গিয়া জড়ো হইল। স্বভাবদোষে সেখানেও বিদ্রোহের হাওয়া তুলিয়াছিলাম, জগদিন্দ্ৰ হইয়াছিলেন তাহার সহায়। তখন প্রাদেশিক সম্মিলনীতে বক্তৃতাদি হইত