পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ 는 8C: হাতের বালা, রুপার চুড়ি, বেনারসি শাড়ি এবং শাল পর্যন্ত বিক্রয় শেষ করিয়া বিস্তর বিনীত অনুনয়পূর্বক মাথার দিব্য দিয়া অশ্রুজলে পত্রের প্রত্যেক অক্ষর পংক্তি বিকৃত করিয়া বিন্ধ্য স্বামীকে ফিরিয়া আসিতে অনুরোধ করিল। স্বামী চুল থাটাে করিয়া, দাড়ি কামাইয়া কোটপ্যানটুলুন পরিয়া, ব্যারিস্টার হইয়া ফিরিয়া আসিলেন এবং হোটেলে আশ্রয় লইলেন । পিতৃগৃহে বাস করা অসম্ভব— প্রথমত উপযুক্ত স্থান নাই, দ্বিতীয়ত পল্লীবাসী দরিদ্র গৃহস্থ জাতি নষ্ট হইলে একেবারে নিরুপায় হইয়া পড়ে। শ্বশুরগণ আচারনিষ্ঠ পরম হিন্দু, তাহারাও জাতিচু্যতকে আশ্রয় দিতে পারেন না । অর্থাভাবে অতি শীঘ্রই হোটেল হইতে বাসায় নামিতে হইল। সে বাসায় তিনি স্ত্রীকে আনিতে প্রস্তুত নহেন। বিলাত হইতে আসিয়া স্ত্রী এবং মাতার সহিত কেবল দিন দুই-তিন দিনের বেলায় দেখা করিয়া আসিয়াছেন, তাহদের সহিত আর সাক্ষাং হয় নাই। দুইটি শোকার্তা রমণীর কেবল এক সাস্বনা ছিল যে, অনাথবন্ধু স্বদেশে আত্মীয়বর্গের নিকটবর্তী স্থানে আছেন। সেই সঙ্গে সঙ্গে অনাথবন্ধুর অসামান্য ব্যারিস্টারি কীর্তিতে তাহাদের মনে গর্বের সীমা রহিল না। বিন্ধ্যবাসিনী আপনাকে যশস্বী স্বামীর অযোগ্য স্ত্রী বলিয়া ধিক্কার দিতে লাগিল, পুনশ্চ অযোগ্য বলিয়াই স্বামীর অহংকার অধিক করিয়া অনুভব করিল। সে দুঃখে পীড়িত এবং গর্বে বিস্ফারিত হইল। ম্লেচ্ছ আচার সে ঘূণা করে, তবু স্বামীকে দেখিয়া মনে মনে কহিল, “আজকাল ঢের লোক তো সাহেব হয়, কিন্তু এমন তো কাহাকেও মানায় না— একেবারে ঠিক যেন বিলাতি সাহেব ! বাঙালি বলিয়া চিনিবার যো নাই ।” বাসাখরচ যখন অচল হইয়া আসিল ; যখন অনাথবন্ধু মনের ক্ষোভে স্থির করিলেন, অভিশপ্ত ভারতবর্ষে গুণের সমাদর নাই এবং তাহার স্বব্যবসায়ীগণ ঈর্ষাবশত র্তাহার উন্নতিপথে গোপনে বাধা স্থাপন করিতেছে ; যখন তাহার খানার ডিশে আমিষ অপেক্ষা উদ্ভিজ্জের পরিমাণ বাড়িয়া উঠিতে লাগিল, দগ্ধকুকুটের সম্মানকর স্থান ভজিত চিংড়ি একচেটে করিবার উপক্রম করিল, বেশভূষার চিকুণতা এবং ক্ষৌরমন্থণ মুখের গর্বোজ্জল জ্যোতি মান হইয়া আসিল ; যখন স্বতীব্র নিখাদে-বাধা জীবনতন্ত্রী ক্রমশ সকরুণ কড়ি মধ্যমের দিকে নামিয়া আসিতে লাগিল— এমন সময় রাজকুমার বাবুর পরিবারে এক গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটয়া অনাথবন্ধুর সংকটসংকুল জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনয়ন করিল। একদা গঙ্গাতীরবর্তী মাতুলালয় হইতে নৌকাযোগে ফিরিবার সময় রাজকুমার বাবুর একমাত্র পুত্র হরকুমার টিমারের সংঘাতে স্ত্রী এবং বালক পুত্র সহ জলমগ্ন হইয়া