পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨ઉ જ রবীন্দ্র-রচনাবলী দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ জজ মোহিতমোহন দত্ত স্ট্যাটুটরি সিভিলিয়ান। তাহার কঠিন বিচারে ক্ষীরোদার ফঁাসির হুকুম হইল। হতভাগিনীর অবস্থা বিবেচনা করিয়া উকিলগণ তাহাকে বঁাচাইবার জন্য বিস্তর চেষ্টা করিলেন কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইলেন না। জজ তাহাকে তিলমাত্র দয়ার পাত্ৰী বলিয়া মনে করিতে পারিলেন না । না পারিবার কারণ আছে ; একদিকে তিনি হিন্দুমহিলাগণকে দেবী আখ্যা দিয়া থাকেন, অপরদিকে স্ত্রীজাতির প্রতি তাহার আন্তরিক অবিশ্বাস। র্তাহার মত এই ষে, রমণীগণ কুলবন্ধন ছেদন করিবার জন্য উন্মুখ হইয়া আছে, শাসন তিলমাত্র শিথিল হইলেই সমাজপিঞ্জরে একটি কুলনারীও অবশিষ্ট থাকিবে না। র্তাহার এরূপ বিশ্বাসেরও কারণ আছে। সে কারণ জানিতে গেলে মোহিতের যৌবন-ইতিহাসের কিয়দংশ আলোচনা করিতে হয়। মোহিত যখন কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়িতেন তখন আকারে এবং আচারে এখনকার হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকারের মানুষ ছিলেন। এখন মোহিতের সম্মুখে টাক, পশ্চাতে টিকি, মুণ্ডিত মুখে প্রতিদিন প্রাতঃকালে থরক্ষুরধারে গুম্ফশ্মশ্রর অঙ্কুর উচ্ছেদ হইয়া থাকে ; কিন্তু তখন তিনি সোনার চশমার গোফদাড়িতে এবং সাহেবি ধরনের কেশবিন্যাসে উনবিংশ শতাব্দীর নূতনসংস্করণ কাতিকটির মতো ছিলেন। বেশভূষায় বিশেষ মনোযোগ ছিল, মদ্যমাংসে অরুচি ছিল না এবং আনুষঙ্গিক আরো দুটো-একটা উপসর্গ ছিল। অদূরে একঘর গৃহস্থ বাস করিত। তাহদের হেমশশী বলিয়া এক বিধবা কন্য ছিল। তাহার বয়স অধিক হইবে না । চৌদ্দ হইতে পনেরোয় পড়িবে। সমুদ্র হইতে বনরাজিনীল তটভূমি যেমন রমণীয় স্বপ্লবৎ চিত্রবৎ মনে হয় এমন তীরের উপর উঠিয়া হয় না। বৈধব্যের বেষ্টন-অন্তরালে হেমশশী সংসার হইতে যেটুকু দূরে পড়িয়াছিল সেই দূরত্বের বিচ্ছেদবশত সংসারটা অহার কাছে পরপারবতা পরমরহস্যময় প্রমোদবনের মতো ঠেকিত। সে জানিত না এই জগৎ-যন্ত্রটার কলকারখানা অত্যন্ত জটিল এবং লৌহকঠিন— মুখে দুঃখে, সম্পদে বিপদে, সংশয়ে সংকটে ও নৈরাশ্বে পরিতাপে বিমিশ্রিত। তাহার মনে হইত, সংসারযাত্রা কলনাদিনী নিঝরিণীর স্বচ্ছ জলপ্রবাহের মতো সহজ, সন্মুখবর্তী সুন্দর পৃথিবীর সকল পথগুলিই প্রশস্ত ও সরল, মুখ কেবল তাহার বাতায়নের বাহিরে এবং তৃপ্তিহীন আকাঙ্ক্ষা কেবল তাহার বক্ষপঞ্জরবর্তী স্পন্দিত পরিতপ্ত কোমল হৃদয়টুকুর অভ্যস্তরে। বিশেষত, তখন তাহার