পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ૨૮૧ যেন নিজে পাখা খাইতেছি, এইরূপ ভান করিয়া রাত্রে যদি তাহাকে তাহার জরের সময় পাখা করিতে যাইতাম তো ভারি একটা কাড়াকড়ি ব্যাপার পড়িয়া বাইত। কোনোদিন যদি তাহার শুশ্ৰষা উপলক্ষে আমার আহারের নিয়মিত সময় দশ মিনিট উত্তীর্ণ হইয়া যাইত, তবে সেও নানাপ্রকার অনুনয় অনুরোধ অমুযোগের কারণ হইয়া দাড়াইত। স্বল্পমাত্র সেবা করিতে গেলে হিতে বিপরীত হইয়া উঠিত। তিনি বলিতেন, “পুরুষমানুষের অতটা বাড়াবাড়ি ভালো নয়।” আমাদের সেই বরানগরের বাড়িটি বোধ করি তুমি দেখিয়াছ। বাড়ির সামনেই বাগান এবং বাগানের সম্মুখেই গঙ্গা বহিতেছে। আমাদের শোবার ঘরের নীচেই দক্ষিণের দিকে খানিকটা জমি মেহেদির বেড়া দিয়া ঘিরিয়া আমার স্ত্রী নিজের মনের মতো একটুকরা বাগান বানাইয়াছিলেন। সমস্ত বাগানটির মধ্যে সেই খগুটিই অত্যন্ত সাদাসিধা এবং নিতান্ত দিশি। অর্থাৎ, তাহার মধ্যে গন্ধের অপেক্ষ বর্ণের বাহার, ফুলের অপেক্ষা পাতার বৈচিত্র্য ছিল না, এবং টবের মধ্যে অকিঞ্চিৎকর উদ্ভিজ্জের পাশ্বে কাঠ অবলম্বন করিয়া কাগজে নির্মিত লাটিন নামের জয়ধ্বজা উড়িত না। বেল, জুই, গোলাপ, গন্ধরাজ, করবী এবং রজনীগন্ধারই প্রাদুর্ভাব কিছু বেশি। প্রকাও একটা বকুলগাছের তলা সাদা মাৰ্বল পাথর দিয়া বাধানো ছিল । সুস্থ অবস্থায় তিনি নিজে দাড়াইয়া দুইবেলা তাহ ধুইয়া সাফ করাইয়া রাখিতেন। গ্রীষ্মকালে কাজের অবকাশে সন্ধ্যার সময় সেই তাহার বসিবার স্থান ছিল। সেখান হইতে গঙ্গা দেখা যাইত কিন্তু গঙ্গা হইতে কুঠির পানসির বাবুরা তাহাকে দেখিতে পাইত না । অনেকদিন শয্যাগত থাকিয়া একদিন চৈত্রের শুক্লপক্ষ সন্ধ্যায় তিনি কহিলেন, “ঘরে বদ্ধ থাকিয়া আমার প্রাণ কেমন করিতেছে ; আজ একবার আমার সেই বাগানে গিয়া বসিব ।” আমি তাহাকে বহু যত্বে ধরিয়া ধীরে ধীরে সেই বকুলতলের প্রস্তরবেদিকায় লইয়া গিয়া শয়ন করাইয়া দিলাম। আমারই জাহুর উপরে তাহার মাথাটি তুলিয়া রাখিতে পারিতাম কিন্তু জানি, সেটাকে তিনি অদ্ভুত আচরণ বলিয়া গণ্য করিবেন, তাই একটি বালিশ আনিয়া তাহার মাথার তলায় রাখিলাম । দুটি-একটি করিয়া প্রস্ফুট বকুল ফুল ঝরিতে লাগিল এবং শাখাস্তরাল হইতে ছায়াঙ্কিত জ্যোৎস্না তাহার শীর্ণ মুখের উপর আসিয়া পড়িল। চারি দিক শাস্ত নিস্তন্ধ ; সেই ঘনগন্ধপূর্ণ ছায়ান্ধকারে একপাশ্বে নীরবে বসিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আমার চোখে জল আসিল । 尊 轉 - আমি ধীরে ধীরে কাছের গোড়ায় আসিয়া দুই হস্তে র্তাহার একটি উত্তপ্ত শীর্ণ হাত