পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জাপানযাত্রী "එOS দিয়েছে। প্রসন্ন তার মুখ, উদার তার হৃদয়, মধুর তার স্বভাব। যতদিন তার বাড়িতে ছিলুম, আমি জানতেই পারি নি তিনি কত বড়ো শিল্পী। ইতিমধ্যে য়োকোহামায় একজন ধনী এবং রসজ্ঞ ব্যক্তির আমরা আতিথ্য লাভ করেছি। র্তার এই বাগানটি নন্দনবনের মতো এবং তিনিও সকল বিষয়ে এখানকারই যোগ্য। র্তার নাম হারা। র্তার কাছে শুনলুম, য়োকোয়াম টাইকান এবং তানজান শিমোমুরা আধুনিক জাপানের দুই সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী। তারা আধুনিক যুরোপের নকল করেন না, প্রাচীন জাপানেরও না। তার প্রথার বন্ধন থেকে জাপানের শিল্পকে মুক্তি দিয়েছেন। হারার বাড়িতে টাইকনের ছবি যখন প্রথম দেখলুম, আশ্চর্য হয়ে গেলুম । তাতে না আছে বাহুল্য, না আছে শৌখিনতা। তাতে যেমন একটা জোর আছে তেমনি সংযম। বিষয়টা এই— চীনের একজন প্রাচীন কালের কবি ভাবে ভোর হয়ে চলেছে ; তার পিছনে একজন বালক একটি বীণাযন্ত্র বহু যত্বে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে তার নেই ; তার পিছনে একটি বাকা উইলো গাছ । জাপানে তিনভাগওয়ালা যে খাড়া পর্দার প্রচলন আছে সেই রেশমের পর্দার উপর আঁকা ; মস্ত পর্দা এবং প্রকাগু ছবি। প্রত্যেক রেখা প্রাণে ভরা। এর মধ্যে ছোটোখাটো কিম্বা জবড়জঙ্গ কিছুই নেই ; যেমন উদার তেমনি গভীর, তেমনি আয়াসহীন । নৈপুণ্যের কথা একেবারে মনেই হয় না ; নানা রঙ নানা রেখার সমাবেশ নেই ; দেখবামাত্র মনে হয় খুব বড়ো এবং খুব সত্য। তার পরে তার ভূদৃশ্যচিত্র দেখলুম। একটি ছবি— পটের উচ্চপ্রান্তে একখানি পূর্ণ চাদ, মাঝখানে একটি নৌকা, নীচের প্রান্তে দুটাে দেওদার গাছের ডাল দেখা যাচ্ছে ; আর কিছু না, জলের কোনো রেখা পর্যন্ত নেই। জ্যোৎস্নার আলোয় স্থির জল কেবলমাত্র বিস্তীর্ণ শুভ্রতা— এটা যে জল সে কেবলমাত্র ওই নৌকো আছে বলেই বোঝা যাচ্ছে ; আর, এই সর্বব্যাপী বিপুল জ্যোৎস্নাকে ফলিয়ে তোলবার জন্যে যত কিছু কালিমা সে কেবলই ওই দুটো পাইন গাছের ডালে । ওস্তাদ এমন একটা জিনিসকে অঁাকতে চেয়েছেন যার রূপ নেই, যা বৃহৎ এবং নিস্তব্ধ– জ্যোৎস্নারাত্রি— অতলস্পর্শ তার নিঃশব্দতা। কিন্তু, আমি যদি র্তার সব ছবির বিস্তারিত বর্ণনা করতে যাই তা হলে আমার কাগজও ফুরোবে, সময়েও কুলোবে না। হারা সান সবশেষে নিয়ে গেলেন একটি লম্বা সংকীর্ণ ঘরে সেখানে একদিকের প্রায় সমস্ত দেয়াল জুড়ে একটি খাড়া পর্দা দাড়িয়ে। এই পর্দায় শিমোমুরার আঁকা একটি প্রকাগু ছবি। শীতের পরে প্রথম বসন্ত এসেছে ; প্লাম গাছের ডালে একটাও পাতা নেই, সাদা সাদা ফুল ধরেছে, ফুলের পাপড়ি ঝরে ঝরে পড়ছে ; বৃহৎ পর্দার এক প্রান্তে দিগন্তের কাছে রক্তবর্ণ সূর্য দেখা দিয়েছে, পর্দার অপর প্রাস্তে প্লাম গাছের রিক্ত