পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী سرچنb®ا থাকে তবে এমন সম্পূর্ণ নির্বিকার মন কোথায় পাওয়া যাবে যার মধ্যে তার বিশুদ্ধ প্রতিবিম্ব পড়তে পারে! মায়াই তো স্থাই ; সেই স্বষ্টিকেই যদি অবাস্তব বল তা হলে অনাস্থষ্টি আছে কোন চুলোয় ? তার নাগাল পাবে কোন পণ্ডিত ? নানা ছলা কলায় হাবে ভাবে সাজে-সজ্জায় নারী নিজের চার দিকে যে একটি রঙিন রহস্ত স্বষ্টি করে তুলেছে সেই আবরণটা ছাড়িয়ে নিয়ে দেখাই তাকে সত্য দেখা, এ কথা মানি নে। গোলাপ ফুলের মায়ার পর্দাটা তুলে ফেলে তাকে কার্বন নাইট্রোজেন বলে দেখা যেমন সত্য দেখা নয়, এও তেমনি। তুমি বাস্তববাদী বলবে, গোলাপ ফুলের মায়া অকৃত্রিম, মেয়ের মায়া কৃত্রিম । একেবারেই বাজে কথা । মেয়ে নিজের হাতে রং বেঁটে যখন তার কাপড় রাঙায় তখন তার হাতের গোপনে সেই প্রকৃতিই থাকে যে প্রকৃতি সকলের অগোচরে প্রজাপতির পাথায় নিজের অদৃশু তুলি বুলিয়ে দেয়। প্রাণের রাজ্যে মায়ার খেলা কত বর্ণে গন্ধে রসে, কত লুকোচুরিতে, আভাসে ইশারায় দিনরাত প্রকাশ পাচ্ছে। প্রকৃতির সেই-সকল নিত্য অথচ অনিত্য চঞ্চলতায়, সেই-সব নিরর্থক হাবভাবেই তো বিশ্বের সৌন্দর্য । চিরপলাতকের এই চিরপরিবর্তনশীল লীলা থেকে বাদ দিয়ে যে অতি সারবান ভারবান নিশ্চল ধুলোমাটি লোহাপাথরের পিগুটা বাকি থাকে তাকেই তুমি বাস্তবসত্য বল না-কি। বসনে ভূষণে, আড়ালে আবডালে, দ্বিধায় দ্বম্বে, ভাবে ভঙ্গীতে মেয়ে তো মায়াবিনীই বটে। তার মায়ার জগতে সে ইন্দ্রজাল বিস্তার করেছে— যেমন মায়া যেমন ইন্দ্রজাল জলে স্থলে, ফুলে ফলে, সমুদ্র পর্বতে, ঝড়ে বন্যায়। যাই হোক, এই মায়াবিনীই চাদের সঙ্গে, ফুলের সঙ্গে, নববর্ষার মেঘের সঙ্গে, কলনৃত্যভঙ্গিনী নদীর সঙ্গে মিলে পুরুষের সামনে এসে দাড়াল। এই নারী একটা বাস্তবের পিগুমাত্র নয় ; এর মধ্যে কলাস্থষ্টির একটা তত্ত্ব আছে ; অগোচর একটি নিয়মের বাধনে ছন্দের ভঙ্গীতে সে রচিত ; সে একটি অনির্বচনীয় স্বসমাপ্তির মূতি। নানা বাজে খুঁটিনাটিকে সে মধুর নৈপুণ্যে সরিয়ে দিয়েছে ; সাজে-সজ্জায় চালে চলনে নানা ব্যঞ্জনা দিয়ে নিজেকে সে বস্তুলোকের প্রত্যস্তদেশে রসলোকের অধিবাসিনী করে দাড় করিয়েছে। “কাজ করে থাকি” এই কথাটা জানিয়ে পুরুষ হাত খালি রেখেছে ; মেয়ে সেই হাতে কঁাকন পরে জানিয়েছে, “আমি তো কাজ করি নে, আমি সেবা করি।” সেবা হল হৃদয়ের স্বষ্টি, শক্তির চালনা নয়। যে রাস্তায় চলবে সেই রাস্তাটাকে খুব স্পষ্ট করে নিরীক্ষণ করবার জন্যে পুরুষ তার চোখদুটো খুলে রেখেছে, ওটাকে সে গভীর ভাষায় বলে দর্শনেন্দ্রিয়। মেয়ে সেই চোখে একটু কাজলের রেখা টেনে দিয়ে বলেছে, চোখ দিয়ে বাইরের জিনিস দেখা যায় এইটেই চরম কথা নয়— চোখের ভিতরেও দেখবার জিনিস আছে, হৃদয়ের বিচিত্র মায়া ।