পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8●b" রবীন্দ্র-রচনাবলী গাছতলায় দাড়িয়ে হাওয়ায় পড়ে-যাওয়া ফল আঁচলে ভরে দেওয়া। তার কিছু পাকা, কিছু কাচা ; তার কোনোটাতে রং ধরেছে, কোনোটাতে ধরে নি। তার কিছু রাখলেও চলে, কিছু ফেলে দিলেও নালিশ চলবে না । সেই ভাবেই চিঠি লিখতে শুরু করেছিলুম। কিন্তু, আকাশের আলো দিলে মুখ-ঢাকা । বৈঠকখানার আসর বন্ধ হয়ে গেলে ফরাশ বাতি নিবিয়ে দিয়ে যেমন ঝাড়লন্ঠনে ময়লা রঙের ঘেরাটোপ পরিয়ে দেয়, দু্যলোকের ফরাশ সেই কাগুটা করলে ; একটা ফিকে ধোয়াটে রঙের আবরণ দিয়ে আকাশসভার তৈজসপত্র দিলে মুড়ে । এই অবস্থায় আমার মন তার হালকা কলমের খেলা আপনিই বন্ধ করে দেয় । বকুনির কূলহারা ঝরনা বাক্যের নদী হয়ে কখন একসময় গভীর খাদে চলতে আরম্ভ করে ; তখন তার চলাটা কেবলমাত্র স্বর্যের আলোয় কলধ্বনির নূপুর বাজানোর জন্তে নয়, একটা কোনো লক্ষ্যে পৌছবার সাধনায়। আনমনা সাহিত্য তখন লোকালয়ের মাঝখানে এসে পড়ে সমনস্ক হয়ে ওঠে। তখন বাণীকে অনেক বেশি অতিক্রম করে ভাবনাগুলো মাথা তুলে দাড়ায়। উপনিষদে আছে : স নো বন্ধুর্জনিত স বিধাতা ; তিনি ভালোবাসেন, তিনি স্বষ্টি করেন, আবার তিনিই বিধান করেন। স্বষ্টি-করাটা সহজ আনন্দের খেয়ালে, বিধানকরায় চিন্তা আছে । যাকে খাস সাহিত্য বলে সেটা হল সেই স্মৃষ্টিকর্তার এলেকায়, সেটা কেবল আপন মনে । যদি কোনো হিসাবি লোক স্রষ্টাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে "কেন স্থষ্টি করা হল” তিনি জবাব দেন, “আমার খুশি !” সেই খুশিটাই নানা রঙে নানা রসে আপনাতেই আপনি পর্যাপ্ত হয়ে ওঠে। পদ্মফুলকে যদি জিজ্ঞাসা করে। “তুমি কেন হলে” সে বলে, “আমি হবার জন্যেই হলুম।” খাটি সাহিত্যেরও সেই একটিমাত্র জবাব । অর্থাৎ, স্বষ্টির একটা দিক আছে যেটা হচ্ছে স্বষ্টিকর্তার বিশুদ্ধ বকুনি। সেদিক থেকে এমনও বলা যেতে পারে, তিনি আমাকে চিঠি লিখছেন। আমার কোনো চিঠির জবাবে নয়, তার আপনার বলতে ইচ্ছে হয়েছে বলে ; কাউকে তো বলা চাই। অনেকেই মন দিয়ে শোনে না, অনেকে বলে, “এ তে সারবান নয় ; এ তো বন্ধুর আলাপ, এ তো সম্পত্তির দলিল নয়।” সারবান থাকে মাটির গর্ভে, সোনার খনিতে ; সে নেই ফুলের বাগানে, নেই সে উদয়দিগন্তে মেঘের মেলায়। আমি একটা গর্ব করে থাকি, ওই চিঠিলিখিয়ের চিঠি পড়তে পারতপক্ষে কখনো ভুলি নে। বিশ্ববকুনি যখন-তখন আমি শুনে থাকি। তাতে বিষয়কাজের ক্ষতি হয়েছে, আর যারা আমাকে দলে ভিড়িয়ে কাজে লাগাতে চায় তাদের কাছ থেকে নিন্দাও শুনেছি ; কিন্তু আমার এই দশা ।