পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8*३ রবীন্দ্র-রচনাবলী 曹 ষে নূতন রীতি হয়েছে এ সেরকম নয় ; অথচ, যুরোপীয় সংগীতে বহুৰন্ত্রের ষে-হার্যনি এ তাও নয়। ঘণ্টার মতো শব্দে একটা মূল স্বরসমাবেশ কানে আসছে ; তার সঙ্গে নানাপ্রকার যন্ত্রের নানারকম আওয়াজ যেন একটা কারুশিল্পে গাখা হয়ে উঠছে। সমস্তটাই যদিও আমাদের থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র, তবু শুনতে ভারি মিষ্টি লাগে। এই সংগীত পছন্দ করতে যুরোপীয়দেরও বাধে না । গামেলান বাজনার সঙ্গে ছোটো মেয়ে দুটি নাচলে ; তার ঐ অত্যন্ত মনোহর । অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে সমস্ত শরীরে ছন্দের যে-আলোড়ন তার কী চারুতা, কী বৈচিত্র্য, কী সৌকুমার্ষ, কী সহজ লীলা । অন্ত নাচে দেখা যায়, নটী তার দেহকে চালনা করছে ; এদের দেখে মনে হতে লাগল, দুটি দেহ যেন স্বত-উৎসারিত নাচের ফোয়ারা । বারো বছরের পরে এই মেয়েদের আর নাচতে দেওয়া হয় না ; বারো বছরের পরে শরীরের এমন সহজ স্বকুমার হিল্লোল থাকা সম্ভব নয় । 曾 সেই সন্ধ্যাবেলাতেই রাজবাড়িতে আর একটি ব্যাপার দেখলুম, মুখোসপর নটেদের অভিনয় । আমরা জাপান থেকে যে-সব মুখোস এনেছিলুম তার থেকে বেশ বোঝা যায় মুখোসতৈরি এক প্রকারের বিশেষ কলাবিদ্যা। এতে যথেষ্ট গুণপন চাই । আমাদের সকলেরই মুখে যেমন ব্যক্তিগত তেমনি শ্রেণীগত বিশেষত্ব আছে। বিশেষ ছাচ ও ভাব-প্রকাশ অনুসারে আমাদের মুখের ছাদ এক-একরকম শ্রেণী নির্দেশ করে। মুখোসতৈরি যে-গুণী করে সে সেই শ্রেণী:প্রকৃতিকে মুখোসে বেঁধে দেয়। সেই বিশেষশ্রেণীর মুখের ভাববৈচিত্র্যকে একটি বিশেষ ছাদে সে সংহত করে। নট সেই মুখোস পরে এলে আমরা তখনই দেখতে পাই, একটা বিশেষ মানুষকে কেবল নয়, বিশেষ ভাবের এক শ্রেণীর মানুষকে । সাধারণত, অভিনেতা ভাব অনুসারে অঙ্গভঙ্গী করে । কিন্তু, মুখোসে মুখের ভঙ্গী স্থির করে বেঁধে দিয়েছে। এইজন্যে অভিনেতার কাজ হচ্ছে মুখোসেরই সামঞ্জস্ত রেখে অঙ্গভঙ্গী করা । মূল ধুয়োটা তার বাধা ; এমন করে তান দিতে হবে যাতে প্রত্যেক স্বরে সেই ধুয়োটার ব্যাখ্যা হয়, কিছু অসংগত না হয়। এই অভিনয়ে তাই দেখলুম। অভিনয়ের সঙ্গে এদের কণ্ঠসংগীত যা শুনেছি তাকে সংগীত বলাই চলে না। আমাদের কানে অত্যন্ত বেস্করো এবং উৎকট ঠেকে। এখানে আমরা তো গ্রামের কাছেই আছি ; এরা কেউ একলা কিম্বা দল বেঁধে গান গাচ্ছে, এ তো শুনি নি। আমাদের পাড়াগায়ে চাঙ্গ উঠেছে অথচ কোথাও গান ওঠে নি, এ সম্ভব হয় না । এখানে সন্ধ্যার আকাশে নারকেলগাছগুলির মাথার উপর শুক্লপক্ষের চাঁদ দেখা দিচ্ছে, গ্রামে কুঁকড়ে ডাকছে, কুকুর ডাকছে, কিন্তু কোথাও মানুষের গান নেই।