পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৯২ রবীন্দ্র-রচনাবলী মেয়েটি কোন জাত ঠাহর হইল না। সদয় হিন্দি ভাষায় জিজ্ঞাসা করিলাম, "কে তুমি, তোমার কী হইয়াছে।” প্রথমে উত্তর দিল না, মেঘের মধ্য হইতে সজলদীপ্তনেত্রে আমাকে একবার দেখিয়া লইল । আমি আবার কহিলাম, “আমাকে ভয় করিয়ো না । আমি ভদ্রলোক ৷” শুনিয়া সে হাসিয়া খাস হিন্দুস্থানিতে বলিয়া উঠিল, “বহুদিন হইতে ভয়ডরের মাথা খাইয়া বসিয়া আছি, লজ্জাশরমও নাই। বাবুজি, একসময় আমি যে-জেনানায় ছিলাম সেখানে আমার সহোদর ভাইকে প্রবেশ করিতে হইলেও অনুমতি লইতে হুইত, আজ বিশ্বসংসারে আমার পর্দা নাই ।” প্রথমটা একটু রাগ হইল ; আমার চালচলন সমস্তই সাহেবী, কিন্তু এই হতভাগিনী বিনা দ্বিধায় আমাকে বাবুজি সম্বোধন করে কেন। ভাবিলাম, এইখানেই আমার উপন্যাস শেষ করিয়া সিগারেটের ধোয়া উড়াইয়া উদ্যতনাসা সাহেবিয়ানার রেলগাড়ির মতো সশব্দে সবেগে সদৰ্পে প্রস্থান করি। অবশেষে কৌতুহল জয়লাভ করিল। আমি কিছু উচ্চভাব ধারণ করিয়া বক্রগ্রীবায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমাকে কিছু সাহায্য করিতে পারি ? তোমার কোনো প্রার্থনা আছে ?” সে স্থিরভাবে আমার মুখের দিকে চাহিল এবং ক্ষণকাল পরে সংক্ষেপে উত্তর করিল, “আমি বভ্রাওনের নবাব গোলামকাদের খার পুত্রী।” বন্দ্ৰাওন কোন মুল্লুকে এবং নবাব গোলামকাদের র্থ কোন নবাব এবং তাহার কন্যা ষে কী দুঃখে সন্ন্যাসিনীবেশে দাৰ্জিলিঙে ক্যালকাটা রোডের ধারে বসিয়া কাদিতে পারে আমি তাহার বিন্দুবিসর্গ জানি না এবং বিশ্বাসও করি না, কিন্তু ভাবিলাম, রসভঙ্গ করিব না, গল্পটি দিব্য জমিয়া আসিতেছে । তৎক্ষণাৎ স্বগম্ভীর মুখে স্বদীর্ঘ সেলাম করিয়া কহিলাম, "বিবিলাহেব, মাপ করে, তোমাকে চিনিতে পারি নাই।” চিনিতে না পারিবার অনেকগুলি যুক্তিসংগত কারণ ছিল, তাহার মধ্যে সর্বপ্রধান কারণ, তাহাকে পূর্বে কস্মিনকালে দেখি নাই, তাহার উপর এমনি কুয়াশা ষে নিজের হাত পা কয়খানিই চিনিয়া লওয়া দুঃসাধ্য। বিবিলাহেবও আমার অপরাধ লইলেন না এবং সন্তুষ্টকণ্ঠে দক্ষিণহস্তের ইঙ্গিতে স্বতন্ত্র শিলাখণ্ড নির্দেশ করিয়া আমাকে অনুমতি করিলেন, “বৈঠিয়ে ।” দেখিলাম, রমণীটির আদেশ করিবার ক্ষমতা আছে । আমি তাহার নিকট হইতে সেই সিক্ত শৈবালাচ্ছন্ন কঠিনবন্ধুর শিলাখণ্ডতলে আসনগ্রহণের সম্মতি প্রাপ্ত হইয়া