পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२७8 রবীন্দ্র-রচনাবলী দক্ষিণ হস্ত তুলিয়া নীরবে অঙ্গুলিসংকেতে ডাকিল। তাহার চার আঙুলের অস্থিতে হীরার আংটি ঝকমক্‌ করিয়া উঠিল। ফণিভূষণ মূঢ়ের মতো উঠিয়া দাড়াইল । কঙ্কাল দ্বারের অভিমুখে চলিল , হাড়েতে হাড়েতে গহনায় গহনায় কঠিন শব্দ হইতে লাগিল। ফণিভূষণ পাশবদ্ধ পুত্তলীর মতো তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল । বারান্দা পার হইল, নিবিড় অন্ধকার গোলসিড়ি ঘুরিয়া ঘুরিয়া খট্‌খট্‌ ঠকঠক কমৃঝম্ করিতে করিতে নীচে উত্তীর্ণ হইল । নীচেকার বারান্দা পার হইয়া জনশূন্ত দীপহীন দেউড়িতে প্রবেশ করিল। অবশেষে দেউড়ি পার হইয়া ইটের-খোয়-দেওয়া বাগানের রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল । খোয়াগুলি অস্থিপাতে কড়কড়, করিতে লাগিল । সেখানে ক্ষীণ জ্যোংক্ষা ঘন ডালপালার মধ্যে আটক খাইয়া কোথাও নিষ্কৃতির পথ পাইতেছিল না ; সেই বর্ষার নিবিড়গন্ধ অন্ধকার ছায়াপথে জোনাকির বাণকের মধ্য দিয়া উভয়ে নদীর ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইল । - 螺 ঘাটের যে ধাপ বাহিয়া শব্দ উপরে উঠিয়াছিল সেই ধাপ দিয়া অলংকৃত কঙ্কাল তাহার আন্দোলনহীন ঋজুগতিতে কঠিন শব্দ করিয়া এক-পা এক-পা নামিতে লাগিল। পরিপূর্ণ বর্ষানদীর প্রবলস্রোত জলের উপর জ্যোৎস্নার একটি দীর্ঘরেখা ঝিকৃঝিক্‌ করিতেছে। কঙ্কাল নদীতে নামিল, অম্বুবতী ফণিভূষণও জলে পা দিল। জলস্পর্শ করিবামাত্র ফণিভূষণের তন্দ্র ছুটিয়া গেল । সম্মুখে আর তাহার পথপ্রদর্শক নাই, কেবল নদীর পরপারে গাছগুলা স্তন্ধ হইয়া দাড়াইয়া এবং তাহীদের মাথার উপরে খণ্ড চাদ শাস্ত অবাকভাবে চাহিয়া আছে । আপাদমস্তক বারম্বার শিহরিয়া শিহরিয়া স্বলিতপদে ফণিভূষণ স্রোতের মধ্যে পড়িয়া গেল । যদিও সাতার জানিত কিন্তু স্বায়ু তাহার বশ মানিল না, স্বপ্নের মধ্য হইতে কেবল মুহূর্তমাত্র জাগরণের প্রান্তে আসিয়া পরক্ষণে অতলম্পর্শ স্বপ্তির মধ্যে নিমগ্ন হুইয়া গেল । গল্প শেষ করিয়া ইস্কুলমাস্টার খানিকক্ষণ থামিলেন । হঠাৎ থামিবামাত্র বোঝা গেল, তিনি ছাড়া ইতিমধ্যে জগতের আর-সকলই নীরব নিস্তন্ধ হইয়া গেছে । অনেকক্ষণ আমি একটি কথাও বলিলাম না এবং অন্ধকারে তিনি আমার মুখের ভাবও দেখিতে পাইলেন না । আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি এ গল্প বিশ্বাস করিলেন না ।”