রবীন্দ্র-রচনাবলী مطياج স্বামীর লজ্জা দূর হইল ; তিনি বলিলেন, “চোখে অন্ত্র করিতে হইবে শুনিলে ভয় না করে, পুরুষের মধ্যে এমন বীর কয়জন আছে।” আমি ঠাট্টা করিয়া বলিলাম, “পুরুষের বীরত্ব কেবল স্ত্রীর কাছে।” স্বামী তৎক্ষণাৎ মান গভীর হইয়া কহিলেন, “সে কথা ঠিক । পুরুষের কেবল অহংকার সার ।” আমি তাহার গাষ্ঠীর্ষ উড়াইয়া দিয়া কহিলাম, “অহংকারেও বুঝি তোমরা মেয়েদের সঙ্গে পার ? তাহাতেও আমাদের জিত ।” ইতিমধ্যে দাদা আসিলে আমি দাদাকে বিরলে ডাকিয়া বলিলাম, "দাদা, আপনার সেই ডাক্তারের ব্যবস্থামত চলিয়া এতদিন আমার চোখ বেশ ভালোই হইতেছিল, একদিন ভ্রমক্রমে খাইবার ওষুধটা চক্ষে লেপন করিয়া তাহার পর হইতে চোখ যায়যায় হইয়া উঠিয়াছে । আমার স্বামী বলিতেছেন, চোখে অন্ত্র করিতে হইবে।” দাদা বলিলেন, “আমি ভাবিতেছিলাম, তোর স্বামীর চিকিৎসাই চলিতেছে, তাই আরো আমি রাগ করিয়া এতদিন আসি নাই ।” আমি বলিলাম, “লা, আমি গোপনে সেই ডাক্তারের ব্যবস্থামতই চলিতেছিলাম, স্বামীকে জানাই নাই, পাছে তিনি রাগ করেন।” স্ত্রীজন্ম গ্রহণ করিলে এত মিথ্যাও বলিতে হয় ! দাদার মনেও কষ্ট দিতে পারি না, স্বামীর যশও ক্ষুন্ন করা চলে না । মা হইয়া কোলের শিশুকে ভুলাইতে হয়, স্ত্রী হইয়া শিশুর বাপকে ভুলাইতে হয়— মেয়েদের এত ছলনার প্রয়োজন। ছলনার ফল হইল এই যে, অন্ধ হইবার পূর্বে আমার দাদা এবং স্বামীর মিলন দেখিতে পাইলাম। দাদা ভাবিলেন, গোপনচিকিৎসা করিতে গিয়া এই দুর্ঘটনা ঘটিল ; স্বামী ভাবিলেন, গোড়ায় আমার দাদার পরামর্শ শুনিলেই ভালো হইত। এই ভাবিয়া দুই অনুতপ্ত হৃদয় ভিতরে ভিতরে ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া পরস্পরের অত্যন্ত নিকটবর্তী হইল। স্বামী দাদার পরামর্শ লইতে লাগিলেন, দাদাও বিনীতভাবে সকল বিষয়ে আমার স্বামীর মতের প্রতিই নির্ভর প্রকাশ করিলেন। অবশেষে উভয়ের পরামর্শক্রমে একদিন একজন ইংরাজ ডাক্তার আসিয়া আমায় বাম চোখে অস্ত্রাঘাত করিল। দুর্বল চক্ষু লে আঘাত কাটাইয়া উঠিতে পারিল না, তাহার ক্ষীণ দীপ্তিটুকু হঠাৎ নিবিয়া গেল। তাহার পরে বাকি চোখটাও দিনে দিনে অল্পে অল্পে অন্ধকারে আবৃত হইয়া গেল। বাল্যকালে শুভদৃষ্টির দিনে যে চন্দনচর্চিত তরুণমূর্তি আমার সম্মুখে প্রথম প্রকাশিত হইয়াছিল তাহার উপরে চিরকালের মতে পর্দা পড়িয়া গেল । 距