পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

さbペ রবীন্দ্র-রচনাবলী হেমাঙ্গিনী বিদায় লইলে আমার পৃথিবীটা শুষ্ক হইয়া গেল— সে আমার প্রাণের মধ্যে যে সৌগন্ধ্য সৌন্দর্য সংগীত যে উজ্জল আলো এবং যে কোমল তরুণতা আনিয়াছিল তাহ চলিয়া গেলে একবার আমার সমস্ত সংসার, আমার চারি দিকে, দুই হাত বাড়াইয়া দেখিলাম, কোথায় আমার কী আছে! আমার স্বামী আসিয়া বিশেষ প্রফুল্লতা দেখাইয়া কহিলেন, “ইহারা গেলেন, এখন বাচা গেল, একটু কাজকর্ম করিবার অবসর পাওয়া যাইবে।” ধিক্ ধিক্‌, আমাকে। আমার জন্য কেন এত চাতুরী। আমি কি সত্যকে ডরাই। আমি কি আঘাতকে কখনো ভয় করিয়াছি। আমার স্বামী কি জানেন না ? যখন আমি দুই চক্ষু দিয়াছিলাম তখন আমি কি শাস্তমনে আমার চিরান্ধকার গ্রহণ করি নাই ? এতদিন আমার এবং আমার স্বামীর মধ্যে কেবল অন্ধতার অন্তরাল ছিল, আজ হইতে আর-একটা ব্যবধান স্বজন হইল। আমার স্বামী ভুলিয়াও কখনো হেমাঙ্গিনীর নাম আমার কাছে উচ্চারণ করিতেন না, যেন তাহার সম্পৰ্কীয় সংসার হইতে হেমাঙ্গিনী একেবারে লুপ্ত হইয়া গেছে, যেন সেখানে লে কোনোকালে লেশমাত্র রেখাপাত করে নাই । অথচ পত্র দ্বারা তিনি যে সর্বদাই তাহার খবর পাইতেছেন, তাহা আমি অনায়াসে অনুভব করিতে পারিতাম ; যেমন পুকুরের মধ্যে বন্যার জল যে দিন একটু প্রবেশ করে সেই দিনই পদ্মের ডাটায় টান পড়ে, তেমনি তাহার ভিতরে একটুও যে দিন স্ফীতির সঞ্চার হয় সে দিন আমার হৃদয়ের মূলের মধ্য হইতে আমি আপনি অনুভব করিতে পারি। কবে তিনি খবর পাইতেন এবং কবে পাইতেন না তাহ আমার কাছে কিছু অগোচর ছিল না। কিন্তু, আমিও তাহাকে তাহার কথা শুধাইতে পারিতাম না । আমার অন্ধকার হৃদয়ে সেই যে উন্মত্ত উদাম উজ্জ্বল সুন্দর তারাটি ক্ষণকালের জন্ত উদয় হইয়াছিল তাহার একটু খবর পাইবার এবং তাহার কথা আলোচনা করিবার জন্য আমার প্রাণ তৃষিত হইয়া থাকিত, কিন্তু আমার স্বামীর কাছে মুহূর্তের জন্ত তাহার নাম করিবার অধিকার ছিল না। আমাদের দুজনার মাঝখানে বাক্যে এবং বেদনায় পরিপূর্ণ এই একটা নীরবতা অটল ভাবে বিরাজ করিত। বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি একদিন বি আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “মাঠাকরুন, ঘাটে যে অনেক আয়োজনে নৌকা প্রস্তুত হইতেছে, বাবামশায় কোথায় যাইতেছেন? আমি জানিতাম, একটা কী উদ্যোগ হইতেছে, আমার অদৃষ্টাকাশে প্রথম কিছুদিন ঝড়ের পূর্বকার নিন্তব্ধতা এবং তাহার পরে প্রলয়ের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মেঘ আসিয়া জমিতেছিল, সংহারকারী শংকর নীরব অঙ্গুলির ইঙ্গিতে তাহার সমস্ত