পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ՀԵ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী তোমার চেয়ে আমাকে বড়ো করিয়া তুলিয়ে না— আমাকে সর্ববিষয়ে তোমার পায়ের নীচে রাখিয়া দাও।” আমি কী কী কথা বলিয়াছিলাম সে কি আমার মনে আছে। ক্ষুব্ধ সমুদ্র কি নিজের গর্জন নিজে শুনিতে পায় । কেবল মনে পড়ে বলিয়াছিলাম, “যদি আমি সতী হই তবে ভগবান সাক্ষী রছিলেন, তুমি কোনোমতেই তোমার ধর্মশপথ লঙ্ঘন করিতে পরিবে না। সে মহাপাপের পূর্বে হয় আমি বিধবা হইব, নয় হেমাঙ্গিনী বাচিয়া থাকিবে না।” এই বলিয়া আমি মূৰ্চিত হইয়া পড়িয়া গেলাম। যখন আমার মূৰ্ছ ভঙ্গ হইয়া গেল তখনো রাত্রিশেষের পাখি ডাকিতে আরম্ভ করে নাই এবং আমার স্বামী চলিয়া গেছেন । Q আমি ঠাকুরঘরে দ্বার রুদ্ধ করিয়া পূজায় বসিলাম। সমস্ত দিন আমি ঘরের বাহির হইলাম না। সন্ধ্যার সময়ে কালবৈশাখী ঝড়ে দালান কঁাপিতে লাগিল। আমি বলিলাম না যে, “হে ঠাকুর, আমার স্বামী এখন নদীতে আছেন, তাহাকে রক্ষা করো।’ আমি কেবল একান্তমনে বলিতে লাগিলাম, ঠাকুর, আমার অদৃষ্টে যাহা হইবার তা হউক, কিন্তু আমার স্বামীকে মহাপাতক হইতে নিবৃত্ত করে । সমস্ত রাত্রি কাটিয়া গেল। তাহার পরদিনও আসন পরিত্যাগ করি নাই । এই অনিদ্রা-অনাহারে কে আমাকে বল দিয়াছিল জানি না, আমি পাষাণমূর্তির সম্মুখে পাষাণমূর্তির মতোই বসিয়া ছিলাম । সন্ধ্যার সময় বাহির হইতে দ্বার-ঠেলাঠেলি আরম্ভ হইল। দ্বার ভাঙিয়া যখন ঘরে লোক প্রবেশ করিল তখন আমি মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া আছি। মুছাভঙ্গে শুনিলাম, “দিদি।” দেখিলাম, হেমাঙ্গিনীর কোলে শুইয়া আছি। মাথা নাড়িতেই তাহার নূতন চেলি খলখল করিয়া উঠিল । হা ঠাকুর, আমার প্রার্থনা শুনিলে না। আমার স্বামীর পতন হইল । হেমাঙ্গিনী মাখা নিচু করিয়া ধীরে ধীরে কহিল, "দিদি, তোমার আশীৰ্বাদ লইতে আসিয়াছি।” প্রথম একমুহূর্ত কাঠের মতো হইয়া পরক্ষণেই উঠিয়া বসিলাম ; কছিলাম, "কেন আশীৰ্বাদ করিব না, বোন। তোমার কী অপরাধ ” হেমাঙ্গিনী তাহার স্বমিষ্ট উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল কহিল, "অপরাধ ! তুমি বিবাহ করিলে অপরাধ হয় না, আর আমি করিলেই অপরাধ ?” হেমাঙ্গিনীকে জড়াইয়া ধরিয়া আমিও হাসিলাম। মনে মনে কছিলাম, জগতে আমার প্রার্থনাই কি চূড়ান্ত। তাহার ইচ্ছাই কি শেষ নহে। যে আঘাত পড়িয়াছে