পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৫২ রবীন্দ্র-রচনাবলী চলমান মানুষের পদে পদে ভারসাম্যের অপ্রতিষ্ঠতা, unstable equilibrium । এতেই তার বিপদ, এতেই তার সম্পদ । চলার চেয়ে পড়াই তার পক্ষে সহজ । ছাগলের ছানা চলা নিয়েই জন্মেছে, মানুষের শিশু চলাকে আপনি স্বষ্টি করেছে ছন্দে। সামনে-পিছনে ডাইনে-বায়ে পায়ে-পায়ে দেহভারকে মাত্রাবিভক্ত করে ওজন বঁচিয়ে তবেই তার চলা সম্ভব হয় । সেটা সহজ নয়, মানবশিশুর চলার ছন্দসাধনা দেখলেই তা বোঝা যায়। যে পর্যন্ত আপন ছন্দকে সে আপনি উদ্ভাবন না করে সে পর্যন্ত তার হামাগুড়ি, অর্থাৎ, ভারাকর্ষণের কাছে তার অবনতি, সে পর্যন্ত সে নৃত্যহীন । চতুষ্পদ জন্তুর নিতাই হামাগুড়ি। তার চলা মাটির কাছে হার মেনে চলা । লাফ দিয়ে যদি-বা সে উপরে ওঠে, পরক্ষণেই মাটির দরবারে ফিরে এসেই তার মাথা হেঁট। বিদ্রোহী মানুষ মাটির একান্ত শাসন থেকে দেহভারকে মুক্ত করে নিয়ে তাতেই চালায় প্রয়োজনের কাজ এবং অপ্রয়োজনের লীলা । ভূমির টানের বিরুদ্ধে ছন্দের সাহায্যে তার এই জয়লব্ধ শক্তি । ঐতরেয় ব্রাহ্মণ বলছেন : আত্মসংস্কৃতির্বাব শিল্পানি । শিল্পই হচ্ছে আত্মসংস্কৃতি । সম্যক রূপদানই সংস্কৃতি, তাকেই বলে শিল্প । আত্মাকে সুসংযত করে মানুষ যখন আত্মার সংস্কার করে, অর্থাৎ তাকে দেয় সম্যক রূপ, সেও তো শিল্প । মাহুষের শিল্পের উপাদান কেবল তো কাঠপাথর নয়, মানুষ নিজে । বর্বর অবস্থা থেকে মানুষ নিজেকে সংস্কৃত করেছে। এই সংস্কৃতি তার স্বরচিত বিশেষ ছন্দোময় শিল্প। এই শিল্প নানা দেশে, নানা কুণলে, নানা সভ্যতায়, নানা আকারে প্রকাশিত, কেননা বিচিত্র তার ছন্দ । ছন্দোময়ং বা এতৈর্যজমান আত্মানং সংস্কুরুতে । শিল্পযজ্ঞের যজমান আত্মাকে সংস্কৃত করেন, তাকে করেন ছন্দোময় | যেমন মানুষের আত্মার তেমনি মানুষের সমাজেরও প্রয়োজন ছন্দোময় সংস্কৃতি । সমাজও শিল্প । সমাজে আছে নানা মত, নানা ধর্ম, নানা শ্রেণী। সমাজের অস্তরে স্বষ্টিতত্ত্ব যদি সক্রিয় থাকে, তা হলে সে এমন ছন্দ উদ্ভাবন করে যাতে তার অংশপ্রত্যংশের মধ্যে কোথাও ওজনের অত্যস্ত বেশি অসাম্য না হয়। অনেক সমাজ পঙ্গু হয়ে আছে ছন্দের এই ক্রটিতে, অনেক সমাজ মরেছে ছন্দের এই অপরাধে । সমাজে যখন হঠাৎ কোনো একটা সংরাগ অতিপ্রবল হয়ে ওঠে তখন মাতাল সমাজ পা ঠিক রাখতে পারে না, ছন্দ থেকে হয় ভ্ৰষ্ট । কিম্বা যখন এমন সকল মতের, বিশ্বাসের, ব্যবহারের বোঝা অচল হয়ে কাধে চেপে থাকে, যাকে ছন্দ বঁচিয়ে সম্মুখে বহন করে চল সমাজের পক্ষে অসম্ভব হয়, তখন সেই সমাজের পরাভব ঘটে। যেহেতু