পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছন্দ s ○2e) জগতের ধর্মই চলা, সংসারের ধর্ম স্বভাবতই সরতে থাকা, সেইজন্তেই তার বাহন ছন্দ । যে গতি ছন্দ রাখে না, তাকেই বলে দুৰ্গতি । মানুষের ছন্দোময় দেহ কেবল প্রাণের আন্দোলনকে নয় তার ভাবের আন্দোলনকেও যেমন সাড়া দেয়, এমন আর কোনো জীবে দেখি নে । অন্ত জন্তুর দেহেও ভাবের ভাষা আছে কিন্তু মানুষের দেহভঙ্গির মতো লে ভাষা চিন্ময়তা লাভ করে নি, তাই তার তেমন শক্তি নেই, ব্যঞ্জন নেই। কিন্তু, এই যথেষ্ট নয়। মানুষ স্থষ্টিকর্তা । স্বষ্টি করতে গেলে ব্যক্তিগত তথ্যকে দাড় করাতে হয় বিশ্বগত সত্যে। স্থখদুঃখ-রাগবিরাগের অভিজ্ঞতাকে আপন ব্যক্তিগত ঐকাস্তিকতা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সেটাকে রূপস্থষ্টির উপাদান করতে চায় মানুষ । ‘আমি ভালোবাসি’ এই কথাটিকে ব্যক্তিগত ভাষায় প্রকাশ করা যেতে পারে ব্যক্তিগত সংবাদ বহন করবার কাজে । আবার, “আমি ভালোবালি’ এই কথাটিকে ‘আমি থেকে স্বতন্ত্র করে স্বষ্টির কাজে লাগানো যেতে পারে, যে স্বষ্টি সর্বজনের, সর্বকালের । যেমন সাজাহানের বিরহশোক দিয়ে স্বস্ট হয়েছে তাজমহল, সাজাহানের স্বষ্টি অপরূপ ছন্দে অতিক্রম করেছে ব্যক্তিগত সাজাহানকে । নৃত্যকলার প্রথম ভূমিকা দেহচাঞ্চল্যের অর্থহীন স্বযমায় । তাতে কেবলমাত্র ছন্দের আনন্দ । গানেরও আদিম অবস্থায় একঘেয়ে তালে একঘেয়ে স্বরের পুনরাবৃত্তি , সে কেবল তালের নেশা-জমানো, চেতনাকে ছন্দের দোল-দেওয়া । তার সঙ্গে ক্রমে ভাবের দোলা মেশে। কিন্তু, এই ভাবব্যক্তি যখন আপনাকে ভোলে, অর্থাৎ ভাবের প্রকাশটাই যখন লক্ষ্য না হয়, তাকে উপলক্ষ করে রূপস্থষ্টিই হয় চরম, তখন নাচটা হয় সর্বজনের ভোগ্য ; সেই নাচটা ক্ষণকালের পরে বিস্তৃত হলেও যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ তার রূপে চিরকালের স্বাক্ষর লাগে । নাচতে দেখেছি সারসকে । সেই নাচকে কেবল আঙ্গিক বলা যায় না, অর্থাৎ টেক্‌নিকেই তার পরিশেষ নয়। আজিকে মন নেই, আছে নৈপুণ্য । সারসের নাচের মধ্যে দেখেছি ভাব এবং তার চেয়েও আরো কিছু বেশি। সারস যখনই মুগ্ধ করতে চেয়েছে আপন দোসরকে তখনই তার মন স্বষ্টি করতে চেয়েছে নৃত্যভঙ্গির সংস্কৃতি, বিচিত্র ছন্দের পদ্ধতি। সারসের মন আপন দেহে এই নৃত্যশিল্প রচনা করতে পেরেছে, তার কারণ তার দেহভারটা অনেক মুক্ত । কুকুরের মনে আবেগের প্রবলতা যথেষ্ট্র, কিন্তু তার দেহটা বন্ধক দেওয়া মাটির কাছে। মুক্ত আছে কেবল তার ল্যাজ । ভাবাবেগের চাঞ্চল্যে কুকুরীর ছন্দে ওই ল্যাজটাতেই চঞ্চল হয় তার মৃত্য, দেহ অঁাকুবাকু করে বন্দীর মতো ।