পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

©8 e রবীন্দ্র-রচনাবলী পঞ্চক। সে কী রকম ? দাদাঠাকুর। যে ছেলের ভরসা নেই সে অন্ধকারে বিছানায় মাকে না দেখতে পেলেই কাদে, আর যার ভরসা আছে সে হাত বাড়ালেই মাকে তখনই বুক ভরে পায়। তখন ভয়ের অন্ধকারটাই আরো নিবিড় মিষ্টি হয়ে ওঠে। মা তখন যদি জিজ্ঞাসা করে, ‘আলো চাই ? ছেলে বলে, ‘তুমি থাকলে আমার আলোও যেমন অন্ধকারও তেমনি । পঞ্চক। দাদাঠাকুর, অামার অচলায়তন ছেড়ে অনেক সাহস করে তোমার কাছ অবধি এসেছি, কিন্তু তোমার ঐ বন্ধু পর্যন্ত যেতে সাহস করতে পারছি নে। দাদাঠাকুর । কেন, তোমার ভয় কিসের ? পঞ্চক। খাচায় যে পাখিটার জন্ম, সে আকাশকেই সব চেয়ে ডরায় । সে লোহার শলাগুলোর মধ্যে দুঃখ পায় তবু দরজাটা খুলে দিলে তার বুক দুর চুরু করে, ভাবে, বন্ধ না থাকলে বাচব কী করে । আপনাকে যে নিৰ্ভয়ে ছেড়ে দিতে শিখি নি। এইটেই আমাদের চিরকালের অভ্যাস । দাদাঠাকুর । তোমরা অনেকগুলো তালা লাগিয়ে সিন্ধুক বন্ধ করে রাখাকেই মস্ত লাভ মনে কর— কিন্তু সিন্ধুকে-যে আছে কী তার খোজ রাখ না। পঞ্চক। আমার দাদা বলে, জগতে যা-কিছু আছে সমস্তকে দূর করে ফেলতে পারলে তবেই আসল জিনিসকে পাওয়া যায়। সেইজন্তেই দিনরাত্রি আমরা কেবল দূরই করছি— আমাদের কতটা গেল সেই হিসাবটাই আমাদের হিসাব— সে হিসাবের অস্তও পাওয়া যাচ্ছে না । দাদাঠাকুর । তোমার দাদা তো ঐ বলে, কিন্তু আমার দাদা বলে, যখন সমস্ত পাই তখনই আসল জিনিসকে পাই। সেইজন্তে ঘরে আমি দরজা দিতে পারি নে— দিনরাত্রি সব খুলে রেখে দিই। আচ্ছা পঞ্চক, তুমি যে তোমাদের আয়তন থেকে বেরিয়ে আস কেউ তা জানে না ? পঞ্চক । আমি জানি যে আমাদের আচার্য জানেন । কোনোদিন তার সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথা হয় নি— তিনিও জিজ্ঞাসা করেন না, আমিও বলি নে । কিন্তু আমি যখন বাইরে থেকে ফিরে যাই তিনি আমাকে দেখলেই বুঝতে পারেন। আমাকে তখন কাছে নিয়ে বসেন, র্তার চোখের যেন একটা কী ক্ষুধ তিনি আমাকে দেখে মেটান। যেন বাইরের আকাশটাকে তিনি আমার মুখের মধ্যে দেখে নেন। ঠাকুর, যেদিন তোমার সঙ্গে আচার্যদেবকে মিলিয়ে দিতে পারব সেদিন আমার অচলায়তনের সব দুঃখ খুচবে। দাদাঠাকুর। সেদিন আমারও শুভদিন হবে।