পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তুই বোন 8२é আমাকে কেবলই ডাকছে, বলছে, মানুষের রোগের দুঃখ দূর করে।" স্থির করেছি তার নামে একটা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করব।” উমি তার স্বভাবসিদ্ধ উৎসাহে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললে, “খুব ভালো হবে। আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে য়ুরোপে, ডাক্তারি শিখে ফিরে এসে যেন হাসপাতালের ভার নিতে পারি।” কথাটা রাজারামের হৃদয়ে গিয়ে লাগল। বললেন, “ঐ হাসপাতাল হবে দেবত্র সম্পত্তি, তুই হবি সেবায়েত। হেমন্ত বড়ো দুঃখ পেয়ে গেছে, তোকে সে বড়ো ভালোবাসত, তোর এই পুণ্যকাজে পরলোকে সে শাস্তি পাবে। তার রোগশয্যায় তুই তো দিনরাত্রি তার সেবা করেছিস, সেই সেবাই তোর হাতে আরো বড়ো হয়ে উঠবে।” বনেদি ঘরের মেয়ে ডাক্তারি করবে এটাও স্বষ্টিছাড়া বলে বৃদ্ধের মনে হল না । রোগের হাত থেকে মানুষকে বাচানো বলতে যে কতখানি বোঝায় আজ সেটা আপন মর্যের মধ্যে বুঝেছেন। তার ছেলে বাচে নি, কিন্তু অন্যের ছেলের যদি বীচে তা হলে যেন তার ক্ষতিপূরণ হয়, তার শোকের লাঘব হতে পারে। মেয়েকে বললেন, “এখানকার য়ুনিভার্সিটিতে বিজ্ঞানের শিক্ষাটা শেষ হয়ে যাক আগে, তার পরে যুরোপে।” এখন থেকে রাজারামের মনে একটা কথা ঘুরে বেড়াতে লাগল। সে ঐ নীরদ ছেলেটির কথা। একেবারে সোনার টুকরো। যত দেখছেন ততই লাগছে চমৎকার। পাস করেছে বটে, কিন্তু পরীক্ষার তেপান্তর মাঠ পেরিয়ে গিয়ে ডাক্তারিবিদ্যের সাত সমুদ্রে দিনরাত সাতার কেটে বেড়াচ্ছে । অল্প বয়েস, অথচ আমোদপ্রমোদ কোনোকিছুতে টলে না মন । হালের যতকিছু আবিষ্কার তাই আলোচনা করছে উন্টেপাণ্টে, পরীক্ষা করছে, আর ক্ষতি করছে নিজের পসারের। অত্যন্ত অবজ্ঞা করছে তাদের ষাদের পসার জমেছে। বলত, মূর্থের লাভ করে উন্নতি, যোগ্য ব্যক্তিরা লাভ করে গৌরব। কথাটা সংগ্রহ করেছে কোনো-একটা বই থেকে। অবশেষে একদিন রাজারাম উর্মিকে বললেন, “ভেবে দেখলুম, আমাদের হাসপাতালে তুই নীরদের সঙ্গিনী হয়ে কাজ করলেই কাজটা সম্পূর্ণ হবে, আর আমিও নিশ্চিন্ত হতে পারব। ওর মতো অমন ছেলে পাব কোথায় ।” রাজারাম আর যাই পারুন হেমন্তের মতকে অগ্রাহ করতে পারতেন না। সে বলত, মেয়ের পছন্দ উপেক্ষা করে বাপমায়ের পছন্দে বিবাহ ঘটানো বর্বরতা। রাজারাম একদা তর্ক করেছিলেন, বিবাহ ব্যাপারটা শুধু ব্যক্তিগত নয়, তার সঙ্গে সংসার জড়িত, তাই বিবাহে শুধু ইচ্ছার দ্বারা নয় অভিজ্ঞতার দ্বারা চালিত হওয়ার দরকার আছে। তর্ক যেমনই করুন, অভিরুচি যেমনই থাকৃ, হেমন্তের পরে তার স্নেহ এত গভীর ষে, তার ইচ্ছাই এ পরিবারে জয়ী হল।