পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় 6 e a বিষয়ের প্রতি মনকে অভিনিবিষ্ট করিবার উপায় মন্ত্র । আমাদের দেশে উপাসনার এই-যে আশ্চর্য পন্থা স্থই হইয়াছে, ইহা ভারতবর্ষের বিশেষ মাহাত্ম্যের পরিচয় । i * কিন্তু সেই মন্ত্রকে মনন-ব্যাপার হইতে যখন বাহিরে বিক্ষিপ্ত করা হয়, মন্ত্র যখন তাহার উদ্দেশুকে অভিভূত করিয়া নিজেই চরম পদ অধিকার করিতে চায়, তখন তাহার মতো মননের বাধা আর কী হইতে পারে। কতকগুলি বিশেষ শব্দসমষ্টির মধ্যে কোনো অলৌকিক শক্তি অাছে এই বিশ্বাস যখন মানুষের মনকে পাইয়া বসে তখন সে আর সেই শব্দের উপরে উঠতে চায় না। তখন মনন ঘুচিয়া গিয়া সে উচ্চারণের ফঁাদেই জড়াইয়া পড়ে। তখন চিত্তকে যাহা মুক্ত করিবে বলিয়াই রচিত তাহাই চিত্তকে বদ্ধ করে । এবং ক্রমে দাড়ায় এই, মন্ত্ৰ পড়িয়া দীর্ঘ জীবন লাভ করা, মন্ত্ৰ পড়িয়া শক্র জয় করা ইত্যাদি নানাপ্রকার নিরর্থক দুশ্চেষ্টায় মানুষের মুঢ় মন প্রলুব্ধ হইয়া ঘুরিতে থাকে। এইরূপে মন্ত্রই যখন মননের স্থান অধিকার করিয়া বসে তখন মানুষের পক্ষে তাহা অপেক্ষ শুষ্ক জিনিস আর কী হইতে পারে। যেখানে মন্ত্রের এরূপ ভ্ৰষ্টতা সেখানে মানুষের দুর্গতি আছেই। সেই-সমস্ত কৃত্রিম বন্ধন-জাল হইতে মানুষ আপনাকে উদ্ধার করিয়া ভক্তির সজীবতা ও সরসত। -লাভের জন্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে, ইতিহাসে বারংবার ইহার প্রমাণ দেখা গিয়াছে। যাগযজ্ঞ মন্ত্রতন্ত্র যখনই অত্যস্ত প্রবল হইয়া মানুষের মনকে চারি দিকে বেষ্টন করিয়া ধরে তখনই তো মানবের গুরু মানবের হৃদয়ের দাবি মিটাইবার জন্য দেখা দেন ; তিনি বলেন, পাথরের টুকরা দিয়া রুটির টুকরার কাজ চালানো যায় না, বাহ অনুষ্ঠানকে দিয়া অস্তরের শূন্যতা পূর্ণ করা চলে না। কিন্তু তাই বলিয়া এ কথা কেহই বলে ন৷ যে, মন্ত্র যেখানে মননের সহায়, বাহিরের অনুষ্ঠান ষেখানে অস্তরের ভাবস্ফুতির অনুগত, সেখানে তাহা নিন্দনীয় । ভাব তো রূপকে কামনা করে, কিন্তু রূপ যদি ভাবকে মারিয়া একলা রাজত্ব করিতে চায় তবে বিধাতার দণ্ডবিধি -অকুসারে তাহার কপালে মৃত্যু আছেই। কেননা, সে যত দিনই বাচিবে তত দিনই কেবলই মানুষের মনকে মারিতে থাকিবে । ভাবের পক্ষে রূপের প্রয়োজন আছে বলিয়াই রূপের মধ্যে লেশমাত্র অসতীত্ব এমন নিদারুণ । যেখানেই সে নিজেকে প্রবল করিতে চাহিবে সেইখানেই সে নির্লজ্জ, সে অকল্যাণের আকর। কেননা, ভাব যে রূপকে টানিয়া আনে সে ষে প্রেমের টান, আনন্দের– রূপ যখন সেই ভাবকে চাপ দেয় তখন সে সেই প্রেমকে আঘাত করে, আনন্দকে আচ্ছন্ন