পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ՏՕ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বন্দ্রাওনের নবাব গোলামকাদের খার পুত্রী ।” বভ্ৰাওন কোন মুলুকে এবং নবাব গোলামকাদের খা কোন নবাব এবং তাহার কন্যা যে কী দুঃখে৷ সন্ন্যাসিনীবেশে দাৰ্জিলিঙে ক্যালকাটা রোডের ধারে বসিয়া কঁদিতে পারে। আমি তাহার বিন্দুবিসর্গ জানি না এবং বিশ্বাসও করি না, কিন্তু ভাবিলাম, রাসভঙ্গ করিব না, গল্পটি দিব্য জমিয়া আসিতেছে । তৎক্ষণাৎ সুগভীর মুখে সুদীর্ঘ সেলাম করিয়া কহিলাম, “বিবিসিাহেব, মাপ করো, তোমাকে চিনিতে 9ांत्रि नाई ।” চিনিতে না পারিবার অনেকগুলি যুক্তিসংগত কারণ ছিল, তাহার মধ্যে সর্বপ্রধান কারণ, তাহাকে পূর্বে কস্মিনকালে দেখি নাই, তাহার উপর এমনি কুয়াশা যে নিজের হাত পা কয়খানিই চিনিয়া লওয়া দুঃসাধ্য । বিবিসিাহেবও আমার অপরাধ লইলেন না এবং সন্তুষ্টকণ্ঠে দক্ষিণহন্তের ইঙ্গিতে স্বতন্ত্র শিলাখণ্ড দেখিলাম, রমণীটির আদেশ করিবার ক্ষমতা আছে । আমি তাহার নিকট হইতে সেই সিক্ত শৈবালােচ্ছন্ন কঠিনবন্ধুর শিলাখণ্ডতলে আসনগ্রহণের সম্মতি প্রাপ্ত হইয়া এক অভাবনীয় সম্মান লাভ করিলাম। বদ্রাওনের গোলামকাদের ধার পুত্রী নুরউল্পীসা বা মেহেরউল্পীসা বা নূর-উলামূলক আমাকে দাৰ্জিলিঙে ক্যালকাটা রোডের ধারে তাহার অনতিদূরবতী অনতি-উচ্চ পঙ্কিল আসনে বসিবার অধিকার দিয়াছেন । হােটেল হইতে ম্যাকিন্টিশ পরিয়া বাহির হইবার সময় এমন সুমহৎ সম্ভাবনা আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল । হিমালয়বক্ষে শিলাতলে একান্তে দুইটি পান্থ নরনারীর রহস্যালাপকাহিনী সহসা সদ্যসম্পূৰ্ণ কবোঞ্চ কাব্যকথার মতো শুনিতে হয়, পাঠকের হৃদয়ের মধ্যে দূরাগত নির্জন গিরিকন্দিরের নিকারপ্রপাতধ্বনি এবং কালিদাস-রচিত মেঘদূত-কুমারসম্ভবের বিচিত্র সংগীতমৰ্মর জাগ্রত হইয়া উঠিতে থাকে, তথাপি এ কথা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে যে, বুট এবং ম্যাকিস্টশ পরিয়া কালকাটা রোডের ধারে কৰ্দমাসনে এক দীনবেশিনী হিন্দুস্থানী রমণীর সহিত একত্র উপবেশনপূর্বক সম্পূৰ্ণ আত্মগৌরব অক্ষুন্নভাবে অনুভব করিতে পারে, এমন নব্যবঙ্গ অতি অল্পই আছে। কিন্তু সেদিন ঘনঘোর বাম্পে দশ দিক আবৃত ছিল, সংসারের নিকট চক্ষুলজা রাখিবার কোনো বিষয় কোথাও ছিল না, কেবল অনন্ত মেঘরাজ্যের মধ্যে বাদ্রাওনের নবাব গোলামকাদের ধার পুত্রী এবং আমি, এক নববিকশিত বাঙালি সাহেব- দুইজনে দুইখানি প্রস্তরের উপব বিশ্বজগতের দুইখণ্ড প্ৰলিয়াবশেষের ন্যায় অবশিষ্ট ছিলাম, এই বিসদৃশ সম্মিলনের পরম পরিহাস কেবল আমাদের অদৃষ্টর গোচর ছিল, কাহারও দৃষ্টিগোচর ছিল R | আমি কহিলাম, “বিবিসিাহেব, তোমার এ হাল কে করিল ।” বন্দ্ৰাওনকুমারী কপালে করাঘাত করিলেন । কহিলেন, “কে সমস্ত করায় তা আমি কি জানি ! এতবড়ো প্রস্তরময় কঠিন হিমালয়কে কে সামান্য বাম্পের মেঘে অন্তরাল করিয়াছে।” আমি কোনোরূপ দার্শনিক তর্ক না তুলিয়া সমস্ত স্বীকার করিয়া লইলাম ; কহিলাম, “তা বটে, অদৃষ্টের রহস্য কে জানে ! আমরা তো কীটমাত্র।” তর্ক তুলিতাম, বিবিসিাহেবকে আমি এত সহজে নিকৃতি দিতাম না। কিন্তু আমার ভাষায় কুলাইত না। দরোয়ান এবং বেহারাদের সংসর্গে যেটুকু হিন্দি অভ্যন্ত হইয়াছে তাহাতে ক্যালকাটা রোডের ধারে বসিয়া বন্দ্রাওনের অথবা অন্য কোনো স্থানের কোনো নবাবপুত্রীর সহিত অদৃষ্টবাদ ও স্বাধীন ইচ্ছাবাদ সম্বন্ধে সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব হইত। বিবিসিাহেব কহিলেন, “আমার জীবনের আশ্চৰ্য কাহিনী অদ্যই পরিসমাপ্ত হইয়াছে, যদি ফরমায়েশ করেন তো বলি ।” আমি শশব্যন্ত হইয়া কহিলাম, “বিলক্ষণ ! ফরমায়েশ কিসের। যদি অনুগ্রহ করেন তো শুনিয়া শ্ৰবণ সার্থক হইবে ।”