পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

*SQoS & SS সন্ধ্যারতিকালে তপস্বিনীর ভক্তিগদগদ একাগ্ৰ মূর্তি দেখিলাম, তাহার পরে এই দার্জিলিঙে ক্যালকাটা রোডের প্রান্তে প্ৰবীণার কুহেলিকাচ্ছন্ন ভগ্নহৃদয়ভারাকাতর নৈরাশ্যমূর্তিও দেখিলাম, একটি সুকুমার রমণীদেহে ব্ৰাহ্মণমুসলমানের রক্ততরঙ্গের বিপরীত সংঘর্ষজনিত বিচিত্র ব্যাকুল সংগীতধ্বনি সুন্দর সুসম্পূর্ণ উর্দু ভাষায় বিগলিত হইয়া আমার মস্তিকের মধ্যে স্পাদিত হইতে লাগিল । চক্ষু খুলিয়া দেখিলাম, হঠাৎ মেঘ কাটিয়া গিয়া স্নিগ্ধ রৌদ্রে নির্মল আকাশ কলিমল করিতেছে, - ঠেলাগাড়িতে ইংরাজ রমণী ও অশ্বাপূণ্ঠে ইংরাজ পুরুষগণ বায়ুসেবনে বাহির হইয়াছে, মধ্যে মধ্যে দুই-একটি বাঙালির গলাবন্ধবিজড়িত মুখমণ্ডল হইতে আমার প্রতি সকৌতুক কটাক্ষ বৰ্ষিত হইতেছে। দ্রুত উঠিয়া পড়িলাম, এই সূর্যালোকিত অনাবৃত জগৎদৃশ্যের মধ্যে সেই মেঘাচ্ছন্ন কাহিনীকে আর সত্য বলিয়া মনে হইল না। আমার বিশ্বাস, আমি পর্বতের কুয়াশার সহিত আমার সিগারেটের ধূম ভুরিপরিমাণে মিশ্ৰিত করিয়া একটি কল্পনাখণ্ড রচনা করিয়াছিলাম- সেই মুসলমানব্রাহ্মণী, সেই বিপ্ৰবীর, সেই যমুনাতীরের কেল্লা, কিছুই হয়তো সত্য নহে। KPN Seo পুত্ৰযজ্ঞ বৈদ্যনাথ গ্রামের মধ্যে বিজ্ঞ ছিলেন সেইজন্য তিনি ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া বর্তমানের সমস্ত কাজ করিতেন । যখন বিবাহ করিলেন তখন তিনি বর্তমান নববধূর অপেক্ষা ভাবী নবকুমারের মুখ স্পষ্টতররূপে দেখিতে পাইয়াছিলেন। শুভদৃষ্টির সময় এতটা দূরদৃষ্টি প্রায় দেখা যায় না। তিনি পাকা লোক ছিলেন সেইজন্য প্রেমের চেয়ে পিণ্ডটাকেই অধিক বুঝিতেন এবং পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাৰ্যা এই মৰ্মেই তিনি বিনোদিনীকে বিবাহ করিয়াছিলেন । কিন্তু এ সংসারে বিজ্ঞ লোকও ঠিকে । যৌবনপ্রাপ্ত হইয়াও যখন বিনোদিনী তাহার সর্বপ্রধান কর্তব্যটি পালন করিল না। তখন পুল্লাম নরকের দ্বার খোলা দেখিয়া বৈদ্যনাথ বড়ো চিন্তিত হইলেন । মৃত্যুর পরে তাহার বিপুল ঐশ্বৰ্যই বা কে ভোগ করবে। এই ভাবনায় মৃত্যুর পূর্বে তিনি সেই ঐশ্বৰ্য ভোগ করিতে একপ্রকার বিমুখ হইলেন। পূর্বেই বলিয়াছি, বর্তমানের অপেক্ষা ভবিষ্যৎটাকেই তিনি সত্য दलिग्रा खनिष्ठन । কিন্তু যুবতী বিনোদিনীর নিকট হঠাৎ এতটা প্রাজ্ঞতা প্রত্যাশা করা যায় না। সে বেচারার দুর্মুল্য বর্তমান, তাহার নববিকশিত যৌবন, বিনা প্রেমে বিফলে অতিবাহিত হইয়া যায়, এইটেই তাহার পক্ষে সব চেয়ে শোচনীয় ছিল। পারলৌকিক পিণ্ডের ক্ষুধাটা সে ইহলৌকিক চিত্তক্ষুধাদাহে একেবারেই ভুলিয়া বসিয়াছিল, মনুর পবিত্র বিধান এবং বৈদ্যনাথের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যায় তাহার বুভুক্ষিত হৃদয়ে তিলমাত্র তৃপ্তি হইল না। যে যাহাঁই বলুক, এই বয়সটাতে ভালোবাসা দেওয়া এবং ভালোবাসা পাওয়াই রমণীর সকল সুখ এবং সকল কর্তব্যের চেয়ে স্বভাবতই বেশি মনে হয় । কিন্তু বিনোদার ভাগ্যে নবপ্রেমের বর্ষাবরিসিকনের বদলে স্বামীর, পিস শাশুড়িার এবং অন্যান্য গুরু ও গুরুতর লোকের সমুচ্চ আকাশ হইতে তর্জন-গর্জনের শিলাবৃষ্টি ব্যবস্থা হইল। সকলেই তাহাকে বন্ধ্যা বলিয়া অপরাধী কারিত। একটা ফুলের চারাকে আলোক এবং বাতাস হইতে রুদ্ধঘরে রাখিলে তাহার যেরূপ অবস্থা হয়, বিনোদার বঞ্চিত যৌবনেরও সেইরূপ অবস্থা ঘাঁটিয়াছিল। সদাসর্বদা এই সকল চাপচুপি ও বাকবাকির মধ্যে থাকিতে না পারিয়া যখন সে কুসুমের বাড়ি তাস খেলিতে যাইত সেই সময়টা তাহার বড়ো ভালো লাগিতা। সেখানে পুখনয়কের ভীষণ ছায়া সর্বদা বর্তমান না থাকতে হাসি-ঠাট্টা-গল্পের কোনো বাধা ছিল না।