পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SS 8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী छिछकडि আমি পুলিসেব ডিটেকটিভ কর্মচাবী । আমার জীবনে দুটিমাত্ৰ লক্ষ্য ছিল— আমার স্ত্রী এবং আমার ব্যবসায়। পূর্বে একান্নাবতী পরিবারের মধ্যে ছিলাম, সেখানে আমার স্ত্রীর প্রতি সমাদরের অভাব হওয়াতেই আমি দাদার সঙ্গে ঝগড়া করিয়া বাহির হইয়া আসি । দাদাই উপার্জন করিয়া আমাকে পালন করিতেছিলেন, অতএব সহসা সন্ত্রীক তাহার আশ্রয় ত্যাগ করিয়া আসা আমার পক্ষে দুঃসাহসের কাজ হইয়াছিল। কিন্তু কখনো নিজের উপরে আমার বিশ্বাসের ক্রটি ছিল না । আমি নিশ্চয় জানিতাম, সুন্দরী স্ত্রীকে যেমন বশ করিয়াছি বিমুখ অদৃষ্টলক্ষ্মীকেও তেমনি বশ করিতে পারিব । মহিমচন্দ্র এ সংসারে পশ্চাতে পড়িয়া থাকিবে না । পুলিসবিভাগে সামান্যভাবে প্রবেশ করিলাম, অবশেষে ডিটেকটিভ-পদে উত্তীর্ণ হইতে অধিক दिव्लश शश्न न । উজ্জ্বল শিখা হইতেও যেমন কাজলপাত হয় তেমনি আমার স্ত্রীর প্ৰেম হইতেও ঈর্ষা এবং সন্দেহের কালিমা বাহির হইত। সেটাতে আমার কিছু কাজের ব্যাঘাত করিত ; কারণ পুলিসের কর্মে স্থানাস্থান কালাকাল বিচার করিলে চলে না, বরঞ্চ স্থানের অপেক্ষা অস্থান এবং কালের অপেক্ষা অকালটারই চর্চা অধিক করিয়া করিতে হয়- তাহাতে করিয়া আমার স্ত্রীর স্বভাবসিদ্ধ সন্দেহ আরো যেন দুনিবার হইয়া উঠিত । সে আমাকে ভয় দেখাইবার জন্য বলিত, “তুমি এমন যখন-তখন যেখানে-সেখানে যাপন কর, কালেভদ্রে আমার সঙ্গে দেখা হয়, আমার জন্য তোমার আশঙ্কা হয় না ?” আমি তাহাকে বলিতাম, “সন্দেহ করা আমাদের ব্যবসায়, সেই কারণে ঘরের মধ্যে সেটাকে আর আনি না ।” স্ত্রী বলিত, “সন্দেহ করা আমার ব্যবসায় নহে, উহা আমার স্বভাব, আমাকে তুমি লেশমাত্র সন্দেহের কারণ দিলে আমি সব করিতে পারি ।” ডিটেকটিভ। লাইনে আমি সকলের সেরা হইব, একটা নাম রাখিব, এ প্রতিজ্ঞা আমার দৃঢ় ছিল। এ সম্বন্ধে যতকিছু বিবরণ এবং গল্প আছে তাহার কোনোটাই পড়িতে বাকি রাখি নাই। কিন্তু পড়িয়া কেবল মনের অসন্তোষ এবং অধীরতা বাড়িতে লাগিল । কারণ, আমাদের দেশের অপরাধীগুলা ভীরু নির্বোিধ, অপরাধগুলো নিজীব এবং সরল, তাহার মধ্যে দুরূহতা দুৰ্গমতা কিছুই নাই। আমাদের দেশের খুনী নররক্তপাতের উৎকট উত্তেজনা কোনোমতেই নিজের মধ্যে সংবরণ করিতে পারে না । জালিয়াত যো-জাল বিস্তার করে তাহাতে অনতিবিলম্বে নিজেই আপাদমস্তক জড়াইয়া পড়ে, অপরাধবৃহ হইতে নিৰ্গমনের কৃটিকৌশল সে কিছুই জানে না । এমন নিজীব দেশে ডিটেকটিভের কাজে সুখও নাই, গৌরবও নাই। বড়োবাজারের মাড়োয়ারি জুয়াচােরকে অনায়াসে গ্রেপ্তার করিয়া কতবার মনে মনে বলিয়াছি, ওরে অপরাধীকুলকলঙ্ক, পরের সর্বনাশ করা গুণী ওস্তাদলোকের কর্ম ; তোর মতো আনাড়ি নির্বোধের সাধুতপস্বী হওয়া উচিত ছিল |” খুনীকে ধরিয়া তাহার প্রতি স্বাগত উক্তি করিয়াছি, “গবর্মেন্টের সমুন্নত ফাঁসিকাষ্ঠ কি তোদের মতো গৌরববিহীন প্ৰাণীদের জন্য হইয়াছিল- তোদের না আছে। উদার কল্পনাশক্তি, না আছে কঠোর আত্মসংযম, তোরা বেটারা খুনী হইবার স্পর্ধা করিস ' আমি কল্পনাচক্ষে যখন লন্ডন এবং প্যারিসের জনাকীর্ণ পথের দুই পার্থে শীতবাস্পাকুল অভ্ৰভেদী হর্ম্যশ্রেণী দেখিতে পাইতাম তখন আমার শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিত । মনে মনে ভাবিতাম, “এই হর্ম্যােরাজি এবং পথ-উপপথের মধ্য দিয়া যেমন জনস্রোত কর্মস্ৰোত উৎসবস্রোত সৌন্দর্যস্রোত অহরহ বহিয়া যাইতেছে, তেমনি সর্বত্রই একটা হিংস্ৰকুটিল কৃষ্ণকুঞ্চিত ভয়ংকর অপরাধপ্রবাহ তলে তলে আপনার পথ করিয়া চলিয়াছে ; তাহারই সামীপ্যে যুরোপীয় সামাজিকতার হাস্যকৌতুক শিষ্টাচার এমন বিরাটভীষণ রমণীয়তা লাভ করিয়াছে। আর, আমাদের কলিকাতার পথপার্থের মুক্ত বাতায়ন গৃহশ্রেণীর