পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ና፲፱©ጂ w) বাহির করিয়া শ্যালীদের হন্তে চালান করিয়া দিতে লাগিলেন। শ্যালীদের সুন্দর সুকোমল বিদ্বেীষ্ঠের ভিতর হইতে তীক্ষা প্রখর হাসি যখন টুকটুকে মখমলের খাপের ভিতরকার ঝকঝকে ছোরার মতো দেখা দিতে লাগিল, তখন স্থানকালপাত্র সম্বন্ধে হতভাগ্যের চৈতন্য জন্মিল। বুঝিল, “বড়ো ভুল করিয়াছি।” শ্যালীবর্গের মধ্যে জ্যেষ্ঠা এবং রূপে গুণে শ্রেষ্ঠা লাবণ্যলেখা একদা শুভদিন দেখিয়া নবেন্দুর শয়নকক্ষের কুলুঙ্গির মধ্যে দুইজোড়া বিলাতি বুট সিন্দূরে মণ্ডিত করিয়া স্থাপন করিল ; এবং তাহার সম্মুখে ফুলচন্দন ও দুই জ্বলন্ত বাতি রাখিয়া ধূপধুনা জ্বালাইয়া দিল । নবেন্দু ঘরে প্রবেশ করিবামাত্র দুই শালী তাহার দুই কান ধরিয়া কহিল, “তোমার ইষ্টদেবতাকে প্ৰণাম করো, তাহার কল্যাণে তোমার পদবৃদ্ধি হউক ৷” তৃতীয়া শ্যালী কিরণলেখা বহুদিন পরিশ্রম করিয়া একখানি চাদরে জোন্স স্মিথ ব্ৰাউন টমসন প্রভৃতি একশত প্রচলিত। ইংরাজি নাম লাল সুতা দিয়া সেলাই করিয়া একদিন মহাসমারোহে নবেন্দুকে নামাবলি উপহার দিল । চতুর্থ শ্যালী শশাঙ্কলেখা যদিও বয়ঃক্রম হিসাবে গণ্যব্যক্তির মধ্যে নহে, বলিল, “ভাই, আমি একটা জপমালা তৈরি করিয়া দিব, সাহেবের নাম জপ করিবে ।” তাহার বড়ো বোনরা তাহকে শাসন করিয়া বলিল, “যাঃ, তোর আর জ্যাঠামি করিতে হইবে না ।” নবেন্দুর মনে মনে রাগও হয়, লজ্জাও হয়, কিন্তু শ্যালীদের ছাড়িতেও পারে না, বিশেষত বড়োশালীটি বড়ো সুন্দরী । তাহায় মধুও যেমন কাটাও তেমনি ; তাহার নেশা এবং তাহার জ্বালা দুটোই মনের মধ্যে একেবারে লাগিয়া থাকে ! ক্ষতিপক্ষ পতঙ্গ রাগিয়া ভো-ভো করিতে থাকে। অথচ অন্ধ অবোধের মতো চাবি দিকে ঘূরিয়া ঘূবিয়া মরে ; অবশেষে শ্যালীসংসর্গের প্রবল মোহে পড়িয়া সাহেবের সোহাগ-লালসা নিবেন্দু সম্পূর্ণ অস্বীকার করিতে লাগিল । বড়োসাহেবকে যেদিন সেলাম নিবেদন করিতে যাইত শ্যালীদিগকে বলিত, “সুরেন্দ্রবাড়িয্যের বক্তৃতা শুনিতে যাইতেছি।” দাৰ্জিলিং হইতে প্ৰত্যাসন্ন মেজোসাহেবকে শেয়ালদহ স্টেশনে সম্মান জ্ঞাপন করিতে যাইবার সময় শ্যালী দিগকে বলিয়া যাইত, “মেজোমামার সহিত দেখা করিতে চলিলাম ।” সাহেব এবং শ্যালী, এই দুই নীেকায় পা দিয়া হতভাগা বিষম সংকটে পড়িল । শ্যালীরা মনে মনে কহিল, “তোমার অন্য নীেকাটাকে ফুটা না করিয়া ছাড়িব না ।” মহারানীর আগামী জন্মদিনে নবেন্দু খেতাব-স্বৰ্গলোকের প্রথম সোপানে রায়বাহাদুর পদবীতে পদার্পণ করিবেন। এইরূপ গুজব শুনা গেল, কিন্তু সেই সম্ভাবিত সম্মানলাভের আনন্দ-উচ্ছসিত সংবাদ ভীরু বেচারা শ্যালীদিগের নিকটে ব্যক্ত করিতে পারিল না ; কেবল একদিন শরৎশুক্লপক্ষের সায়াহ্নে সর্বনেশে চাদের আলোকে পরিপূর্ণচিত্তাবেগে স্ত্রীর কাছে প্ৰকাশ করিয়া ফেলিল। পরদিন দিবালোকে স্ত্রী পালকি করিয়া তাহার বড়দিদির বাড়ি গিয়া অশ্রাগদগদ কণ্ঠে আক্ষেপ করিতে লাগিল। লাবণ্য কহিল, “তা বেশ তো, রায়বাহাদুর হইয়া তোর স্বামীর তো লেজ বাহির হইবে না, তোর এত লজ্জােটা কিসের ” অরুণলেখা বারংবার বলিতে লাগিল, “না দিদি, আর যা-ই হই, আমি রায়বাহাদুরনী হইতে পারিব | ।।' আসল কথা, অরুণের পরিচিত ভূতনাথবাবু রায়বাহাদুর ছিলেন, পদবীটার প্রতি আন্তরিক আপত্তির কারণ তাহাই । লাবণ্য অনেক আশ্বাস দিয়া কহিল, “আচ্ছা, তোকে সেজন্য ভাবিতে হইবে না ।” বক্সারে লাবণ্যর স্বামী নীলরতন কাজ করিতেন । শরতের অবসানে নবেন্দু সেখান হইতে লাবণ্যর