পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VV8 রবীন্দ্র-রচনাবলী নিমন্ত্রণ পাইলেন । আনন্দচিত্তে অনতিবিলম্বে গাড়ি চড়িয়া যাত্ৰা করিলেন । রেলে চড়িবার সময় তাহার বামাঙ্গ কঁপিল না, কিন্তু তাহা হইতে কেবল এই প্ৰমাণ হয় যে, আসন্ন বিপদের সময় বামাঙ্গ কঁপােটা একটা অমূলক কুসংস্কারমাত্র । লাবণ্যলেখা পশ্চিম প্রদেশের নবশীতাগমসক্তৃত স্বাস্থ্য এবং সৌন্দর্যের অরুণে পাণ্ডুরে পূর্ণপরিস্ফুট হইয়া নির্মল শরৎকালের নির্জন-নদীকুল-ললিতা অম্লানপ্ৰফুল্লা কাশবনশ্ৰীর মতো হাস্যে ও হিল্লোলে কলিমল করিতেছিল । নবেন্দুর মুগ্ধ দৃষ্টির উপরে যেন একটি পূর্ণপুষ্পিতা মালতীলতা নবপ্রভাতের শীতোজ্বল শিশিরকণা ঝলকে ঝলকে বর্ষণ করিতে লাগিল । মনের আনন্দে এবং পশ্চিমের হাওয়ায় নবেন্দুর অজীর্ণ রোগ দূর হইয়া গেল। স্বাস্থ্যের নেশায়, সৌন্দর্যের মোহে এবং শ্যালীহন্তের শুশ্ৰষাপুলকে সে যেন মাটি ছাড়িয়া আকাশের উপর দিয়া চলিতে লাগিল। তাহাদের বাগানের সম্মুখ দিয়া পরিপূর্ণ গঙ্গা যেন তাহারই মনের দুরন্ত পাগলামিকে আকার দান করিয়া বিষম গোলমাল করিতে করিতে প্ৰবল আবেগে নিরুদেশ হইয়া চলিয়া যাইত । ভোরের বেলা নদীতীরে বেড়াইয়া ফিরিবার সময় শীতপ্ৰভাতের সিন্ধারেীন্দ্ৰ যেন প্রিয়মিলনের উত্তাপের মতো তাহার সমস্ত শরীরকে চরিতার্থ করিয়া দিত । তাহার পর ফিরিয়া আসিয়া শ্যালীর শখের রন্ধনে জোগান দিবার ভার লইয়া নবেন্দুর অজ্ঞতা ও অনৈপুণ্য পদে পদে প্ৰকাশ পাইতে থাকিত । কিন্তু, অভ্যাস ও মনোযোগের দ্বারা উত্তরোত্তর তাহা সংশোধন করিয়া লইবার জন্য মূঢ় অনভিঞ্জের কিছুমাত্র আগ্রহ দেখা গেল না, কারণ, প্রত্যহ নিজেকে অপরাধী করিয়া সে যে-সকল তাড়না ভৎসনা লাভ করিত তাহাতে কিছুতেই তাহার তৃপ্তির শেষ হইত না । যথাযথ পরিমাণে মালমসলা বিভাগ, উনান হইতে হাড়ি তোলা-নামা, উত্তাপাধিক্যে ব্যঞ্জন পুড়িয়া না যায় তাহার যথোচিত ব্যবস্থা— ইত্যাদি বিষয়ে সে যে সদ্যোজাত শিশুর মতো অপটু অক্ষম এবং নিরুপায় ইহাই প্রত্যহ বলপূর্বক প্রমাণ করিয়া নবেন্দু শ্যালীর কৃপামিশ্রিত হাস্য এবং হাস্যমিশ্রিত লাঞ্ছনা মনের সুখে ভোগ করিত । মধ্যাহ্নে এক দিকে ক্ষুধার তাড়না অন্য দিকে শ্যালীর পীড়াপীড়ি, নিজের আগ্রহ এবং প্রিয়জনের ঔৎসুক্য, রন্ধনের পারিপাট্য এবং রন্ধনীর সেবামাধুর্য, উভয়ের সংযোগে ভোজন ব্যাপারের ওজন রক্ষা করা তাহার পক্ষে কঠিন হইয়া উঠিত । আহারের পর সামান্য তাঁস খেলাতেও নবেন্দু প্ৰতিভার পরিচয় দিতে পারিত না । চুরি করিত, হাতের কাগজ দেখিত, কাড়াকড়ি বকবকি বাধাইয়া দিত। কিন্তু তবু জিতিতে পারিত না । না জিতিলেও জোর করিয়া তাহার হার অস্বীকার করিত এবং সেজন্য প্ৰত্যহ তাহার গঞ্জনার সীমা থাকিত না ; তথাপিও পাষণ্ড আত্মসংশোধনচেষ্টায় সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল। কেবল এক বিষয়ে তাহার সংশোধন সম্পূর্ণ হইয়াছিল। সাহেবের সোহাগ যে জীবনের চরম লক্ষ্য, এ কথা সে উপস্থিতমত ভুলিয়া গিয়াছিল। আত্মীয়-স্বজনের শ্রদ্ধা ও স্নেহ যে কত সুখের ও গৌরবের ইহাই সে সর্বািন্তঃকরণে অনুভব করিতেছিল। তাহা ছাড়া, সে যেন এক নূতন আবহাওয়ার মধ্যে পড়িয়া গিয়াছিল। লাবণ্যর স্বামী নীলরতনবাবু আদালতে বড়ো উকিল হইয়াও সাহেব সুবাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতেন না বলিয়া অনেক কথা উঠিত । তিনি বলিতেন, “কাজ কী, ভাই ! যদি পাল্টা ভদ্রতা না করে তবে আমি যাহা দিলাম। তাহা তো কোনোমতেই ফিরাইয়া পাইব না । মরুভূমির বালি ফুটফুটে সাদা বলিয়াই কি তাহাতে বীজ বুনিয়া কোনো সুখ আছে ! ফসল ফিরিয়া পাইলে কালো জমিতেও বীজ বোনা যায় ।” নবেন্দুও টানে পড়িয়া দলে ভিড়িয়া গেল। তাহার আর পরিণামচিন্তা রহিল না। পৈতৃক এবং স্বকীয় যত্নে পূর্বে জমি যাহা পাট করা ছিল তাহতেই রায়বাহাদুর খেতাবের সম্ভাবনা। আপনিই বাড়িতে লাগিল। ইতিমধ্যে আর নবজলসিঞ্চনের প্রয়োজন রহিল না। নবেন্দু ইংরাজের বিশেষ একটি শখের শহরে এক বহুব্যয়সাধ্য ঘোড়দৌড়স্থান নির্মাণ করিয়া দিয়াছিলেন ।