পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

qNQu to S ব্ৰত উপলক্ষ করিয়া দুটাে ব্ৰাহ্মণকে খাওয়ানো বা বৈষ্ণবীকে দুটাে পয়সা ভিক্ষা দেওয়া কখনো তাহার দ্বারা ঘটে নাই। তাহার হাতে কোনো জিনিস নষ্ট হয় নাই ; কেবল স্বামীর আদরগুলা ছাড়া আর যাহা পাইয়াছে সমান্তই জমা করিয়া রাখিয়াছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সে নিজের অপরূপ যৌবনশ্ৰী হইতেও যেন লেশমাত্র অপব্যয় ঘটিতে দেয় নাই। লোকে বলে, তাহর চব্বিশ বৎসর বয়সের সময়ও তাহাকে চোদ্দ বৎসরের মতো কঁচা দেখিতে ছিল। যাহাঁদের হৃৎপিণ্ড বরফের পিণ্ড, যাহাঁদের বুকের মধ্যে ভালোবাসার জ্বালাযন্ত্রণা স্থান পায় না, তাহারা বোধ করি সুদীর্ঘকাল তাজা থাকে, তাহারা কৃপণের মতো অন্তরে বাহিরে আপনাকে জমাইয়া রাখিতে পারে। ঘনপাল্পবিত অতিসতেজ লতার মতো বিধাতা মণিমালিকাকে নিস্ফলা করিয়া বাখিলেন, তাহাকে সন্তান হইতে বঞ্চিত করিলেন । অৰ্থাৎ, তাহাকে এমন একটা কিছু দিলেন না। যাহাকে সে আপন লোহার সিন্দুকের মণিমাণিক্য অপেক্ষা বেশি করিয়া বুঝিতে পারে, যাহা বসন্তাপ্ৰভাতের নবসূর্যের মতো আপন কোমল উত্তাপে তাহার হৃদয়ের বরফপিণ্ডটা গলাইয়া সংসারের উপর একটা স্নেহনির্বর বহাইয়া (g কিন্তু মণিমালিকা কাজকর্মে মজবুত ছিল । কখনোই সে লোকজন বেশি রাখে নাই। যে কাজ তাহার দ্বারা সাধ্য সে কাজে কেহ বেতন লইয়া যাইবে ইহা সে সহিতে পারিত না । সে কাহারও জন্য চিন্তা করিত না, কাহাকেও ভালোবাসিত না, কেবল কাজ করিত এবং জমা করিত, এইজন্য তাহার রোগ শোক তাপ কিছুই ছিল না ; অপরিমিত স্বাস্থ্য, অবিচলিত শান্তি এবং সঙ্কীয়মান সম্পদের মধ্যে সে সবলে বিরাজ করিত । অধিকাংশ স্বামীর পক্ষে ইহাই যথেষ্ট ; যথেষ্ট কেন, ইহা দুর্লভ। অঙ্গের মধ্যে কটিদেশ বলিয়া একটা ব্যাপার আছে তাহা কোমরে ব্যথা না হইলে মনে পড়ে না ; গাহের আশ্রয়স্বরূপে স্ত্রী-যে একজন আছে ভালোবাসার তাড়নায় তাহা পদে পদে এবং তাহা চব্বিশঘণ্টা অনুভব করার নাম ঘরকরনার কোমরে ব্যথা । নিরতিশয় পাতিব্ৰতাটা স্ত্রীর পক্ষে গৌরবের বিষয় কিন্তু পতির পক্ষে আরামের নহে, আমার তো এইরূপ মত । মহাশয়, স্ত্রীর ভালোবাসা ঠিক কতটা পাইলাম, ঠিক কতটুকু কম পড়িল, অতি সূক্ষ্ম নিক্তি ধরিয়া তাহা অহরহ তীেল করিতে বসা কি পুরুষমানুষের কর্ম ! স্ত্রী আপনার কাজ করুক, আমি আপনার কাজ করি, ঘরের মোটা হিসাবটা তো এই । অব্যক্তের মধ্যে কতটা ব্যক্তি, ভাবের মধ্যে কতটুকু অভাব, সুস্পষ্টর মধ্যেও কী পরিমাণ ইঙ্গিত, অণুপরমাণুর মধ্যে কতটা বিপুলতা— ভালোবাসাবাসির তত সূসূক্ষ্ম বোধশক্তি বিধাতা পুরুষমানুষকে দেন নাই, দিবার প্রয়োজন হয় নাই । পুরুষমানুষের তিলপরিমাণ অনুরাগ-বিরাগের লক্ষণ লইয়া মেয়েরা বটে ওজন করিতে বসে। কথার মধ্য হইতে আসল ভঙ্গিস্ট্রকু এবং ভঙ্গির মধ্য হইতে আসল কথাটুকু চিরিয়া চিরিয়া চুনিয়া চুনিয়া বাহির করিতে থাকে । কারণ, পুরুষের ভালোবাসাই তাহদের বল, তাহাদের জীবনব্যবসায়ের মূলধন । ইহারই হাওয়ার গতিক লক্ষ্য করিয়া ঠিক সময়ে ঠিকমত পােল ঘুরাইতে পারিলে তবেই তাঁহাদের তরণী তারিয়া যায়। এইজন্যই বিধাতা ভালোবাসামান-যন্ত্রটি মেয়েদের হৃদয়ের মধ্যে বুলাইয়া দিয়াছেন, পুরুষদের | ३ || কিন্তু বিধাতা যাহা দেন নাই সম্প্রতি পুরুষরা সেটি সংগ্ৰহ করিয়া লইয়াছেন । কবিরা বিধাতার উপর টেক্কা দিয়া এই দুর্লভ যন্ত্রটি, এই দিগদর্শন যন্ত্রশিলাকাটি নির্বিচারে সর্বসাধারণের হন্তে দিয়াছেন । বিধাতার দোষ দিই না, তিনি মেয়ে পুরুষকে যথেষ্ট ভিন্ন করিয়াই সৃষ্টি করিয়াছিলেন, কিন্তু সভ্যতায় সে ভেদ আর থাকে না, এখন মেয়েও পুরুষ হইতেছে, পুরুষও মেয়ে হইতেছে ; সুতরাং ঘরের মধ্য হইতে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিদায় লইল । এখন শুভবিবাহের পূর্বে, পুরুষকে বিবাহ করিতেছি না মেয়েকে বিবাহ করিতেছি, তাহা কোনোমতে নিশ্চয় করিতে না পারিয়া, বরকন্যা উভয়েরই চিত্ত আশঙ্কায় দুরু দুরু করিতে থাকে । আপনি বিরক্ত হইতেছেন ; একলা পড়িয়া থাকি স্ত্রীর নিকট হইতে নির্বাসিত ; দূর হইতে সংসারের