পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

'New O8O সেখানে সে আপনার আন্তরিক ক্ষোভ পর্যন্ত চাপিয়া গেল । যেখানে ভালোবাসার একমাত্র অধিকার, সর্বনাশ হইয়া গেলেও সেখানে বলকে প্রবেশ করিতে দিবে না, এই তাহার মনের ভাব । এ সম্বন্ধে তাহাকে যদি ভৎসনা করা যাইত। তবে সম্ভবত সে এইরূপ সূক্ষ্মী তর্ক করিত যে, বাজারে যদি অন্যায় কারণেও আমার ক্রেডিট না থাকে। তবে তাই বলিয়া বাজার লুটিয়া লইবার অধিকার আমার নাই, স্ত্রী যদি স্বেচ্ছাপূর্বক বিশ্বাস করিয়া আমাকে গহনা না দেয়, তবে তাহা আমি কাড়িয়া লইতে পারি না । বাজারে যেমন ক্রেডিট ঘরে তেমনি ভালোবাসা, বাহুবল কেবলমাত্র রণক্ষেত্রে । পদে পদে এইরূপ অত্যন্ত সূক্ষ্মসূক্ষ্ম তর্কসূত্র কাটিবার জন্যই কি বিধাতা পুরুষমানুষকে এরূপ উদার, এরূপ প্রবল, এরূপ বৃহদাকার করিয়া নির্মাণ করিয়াছিলেন । তাহার কি বসিয়া বসিয়া অত্যন্ত সুকুমার চিত্তবৃত্তিকে নিরতিশয় তিনিমার সহিত অনুভব করিবার অবকাশ আছে, না ইহা তাহাকে শোভা পায় । যাহা হউক, আপনি উন্নত হৃদয়বৃত্তির গর্বে স্ত্রীর গহনা স্পর্শ না করিয়া ফণিভূষণ অন্য উপায়ে অর্থ-সংগ্রহের জন্য কলিকাতায় চলিয়া গেল । সংসারে সাধারণত স্ত্রীকে স্বামী যতটা চেনে স্বামীকে স্ত্রী তাহার চেয়ে অনেক বেশি চেনে ; কিন্তু স্বামীর প্রকৃতি যদি অত্যন্ত সূক্ষ্ম হয় তবে স্ত্রীর অণুবীক্ষণে তাহার সমস্তটা ধরা পড়ে না। আমাদের ফণিভূষণকে ফণিভূষণের স্ত্রী ঠিক বুঝিত না ; স্ত্রীলোকের অশিক্ষিতপঢ়ত্ব যে-সকল বহুকালগত প্ৰাচীন সংস্কারের দ্বারা গঠিত, অত্যন্ত নব্য পুরুষেরা তাহার বাহিরে গিয়া পড়ে । ইহারা এক রকমের ! ইহারা মেয়েমানুষের মতোই রহস্যময় হইয়া উঠিতেছে । সাধারণ পুরুষমানুষের যে-কটা বড়ো বড়ো কোটা আছে, অর্থাৎ কেহ-বা বর্বর, কেহ-বা নির্বোিধ, কেহ-বা অন্ধ, তাহার মধ্যে কোনোটাতেই ইহাদিগকে ঠিকমত স্থাপন করা যায় না । সুতরাং মণিমালিকা পরামর্শের জন্য তাহার মন্ত্রীকে ডাকিল। গ্রামসম্পর্কে অথবা দূরসম্পর্কে মণিমালিকার এক ভাই ফণিভূষণের কুঠিতে গোমস্তার অধীনে কাজ করিত। তাহার এমন স্বভাব ছিল না যে কাজের দ্বারা উন্নতি লাভ করে, কোনো-একটা উপলক্ষ করিয়া আখীয়তার জোরে বেতন এবং বেতনেরও বেশি কিছু কিছু সংগ্ৰহ করিত । মণিমালিকা তাহাকে ডাকিয়া সকল কথা বলিল ; জিজ্ঞাসা করিল, “এখন পরামর্শ কী ।” সে অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতো মাথা নাড়িল ; অর্থাৎ গতিক ভালো নহে। বুদ্ধিমানেরা কখনোই গতিক ভালো দেখে না । সে কহিল, “বাবু কখনোই টাকা সংগ্ৰহ করিতে পরিবেন না, শেষকালে তোমার এ গহনাতে টান পড়িবেই।’ মণিমালিকা মানুষকে যেরূপ জানিত তাহাতে বুঝিল, এইরূপ হওয়াই সম্ভব এবং ইহাই সংগত । তাহার দুশ্চিন্তা সুতীব্ৰ হইয়া উঠিল । সংসারে তাহার সন্তান নাই ; স্বামী আছে বটে। কিন্তু স্বামীর অস্তিত্ব সে অন্তরের মধ্যে অনুভব করে না, অতএব যাহা তাহার একমাত্র যত্বের ধন, যাহা তাহার ছেলের মতো ক্রমে ক্রমে বৎসরে বৎসরে বাড়িয়া উঠিতেছে, যাহা রূপকমাত্র নহে, যাহা প্রকৃতই সোনা, যাহা মানিক, যাহা বক্ষের, যাহা কণ্ঠের, যাহা মাথার- সেই অনেকদিনের অনেক সাধের সামগ্ৰী এক মুহুর্তেই ব্যবসায়ের অতলম্পর্শ গহবরের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইবে ইহা কল্পনা করিয়া তাহার সর্বশরীর হিম হইয়া আসিল । সে কহিল, "কী করা যায় ।” মধুসূদন কহিল, "গহনাগুলো লইয়া এইবেলা বাপের বাড়ি চলো।’ গহনার কিছু অংশ, এমন-কি, অধিকাংশই যে তাহার ভাগে আসিবে বুদ্ধিমান মধু মনে মনে তাহার উপায় ঠাহরাইল । মণিমালিকা এ প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ সন্মত হইল । আষাঢ়শেষের সন্ধাবেলায় এই ঘাটের ধারে একখানি নীেকা আসিয়া লাগিল। ঘনমেঘাচ্ছন্ন প্ৰত্যুষে নিবিড় অন্ধকারে নিদ্রাহীন ভেকের কলরবের মধ্যে একখানি মোটা চাদরে পা হইতে মাথা পর্যন্ত আবৃত করিয়া মণিমালিকা নীেকায় উঠিল। মধুসূদন নীেকার মধ্য হইতে জাগিয়া উঠিয়া কহিল, "গহনার বাক্সটা আমার কাছে দাও।' মণি কহিল, ‘সে পরে হইবে, এখন নীেক খুলিয়া দাও।” নীেকা খুলিয়া দিল, খরস্রোতে হুক্ত করিয়া ভাসিয়া গেল।