পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8 br W রবীন্দ্র-রচনাবলী নীরবে অঙ্গুলিসংকেতে ডাকিল। তাহার চার আঙুলের অস্থিতে হীরার আংটি ঝকমক করিয়া উঠিল। ফণিভূষণ মূঢ়ের মতো উঠিয়া দাড়াইল। কঙ্কাল দ্বারের অভিমুখে চলিল; হাড়েতে হাড়েতে গহনায় গহনায় কঠিন শব্দ হইতে লাগিল। ফণিভূষণ পাশবন্ধ পুত্তলীর মতো তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল । নীচে উত্তীর্ণ হইল। নীচেকার বারান্দা পার হইয়া জনশূন্য দীপহীন দেউড়িতে প্ৰবেশ করিল। অবশেষে দেউড়ি পার হইয়া ইটের-খোয়া-দেওয়া বাগানের রান্তায় বাহির হইয়া পড়িল । খোয়াগুলি অহিপাতে কড়কড়া করিতে লাগিল। সেখানে ক্ষীণ জ্যোৎস্না ঘন ডালপালার মধ্যে আটক খাইয়া কোথাও নিকৃতির পথ পাইতেছিল না ; সেই বর্ষার নিবিড়গন্ধ অন্ধকার ছায়াপথে জোনাকির বঁাকের মধ্য দিয়া উভয়ে নদীর ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইল । ঘাটের যে ধাপ বাহিয়া শব্দ উপরে উঠিয়ছিল সেই ধাপ দিয়া অলংকৃত কঙ্কাল তাহার আন্দোলনহীন ঋজুগতিতে কঠিন শব্দ করিয়া এক-পা এক-পা নামিতে লাগিল। পরিপূর্ণ বর্ষানদীর প্ৰবলস্রোত জলের উপর জ্যোৎস্নার একটি দীর্ঘরেখা ঝিকবিক করিতেছে। কঙ্কাল নদীতে নামিল, অনুবতী ফণিভূষণও জলে পা দিল । জলস্পর্শ করিবামাত্র ফণিভূষণের তন্দ্রা ছুটিয়া গেল । সম্মুখে আর তাহার পথপ্রদর্শক নাই, কেবল নদীর পরপারে গাছগুলা স্তব্ধ হইয়া দাড়াইয়া এবং তাহদের মাথার উপরে খণ্ড চাদ শান্ত অবাকভাবে চাহিয়া আছে । আপাদমস্তক বারংবার শিহরিয়া শিহরিয়া স্বলিতপদে ফণিভূষণ স্রোতের মধ্যে পড়িয়া গেল। যদিও সাতার জানিত কিন্তু স্নায়ু তাহার বশ মানিল না, স্বপ্নের মধ্য হইতে কেবল মুহুর্তমাত্র জাগরণের প্রান্তে আসিয়া পরীক্ষণে অতলস্পর্শ সুপ্তির মধ্যে নিমগ্ন হইয়া গেল । গল্প শেষ করিয়া ইস্কুলমাস্টার খানিকক্ষণ থামিলেন । হঠাৎ থামিবামাত্র বোঝা গেল, তিনি ছাড়া ইতিমধ্যে জগতের আর-সকলেই নীরব নিন্তব্ধ হইয়া গেছে । অনেকক্ষণ আমি একটি কথাও বলিলাম না এবং অন্ধকারে তিনি আমার মুখের ভাবও দেখিতে পাইলেন না । আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি এ গল্প বিশ্বাস করিলেন না।” আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি কি ইহা বিশ্বাস করেন ।” তিনি কহিলেন, “না। কেন করি না তাহার কয়েকটি যুক্তি দিতেছি। প্রথমত প্ৰকৃতিঠাকুরানী উপন্যাসলেখিকা নহেন, তাহার হাতে বিস্তর কাজ আছে-” আমি কহিলাম, “দ্বিতীয়ত, আমারই নাম শ্ৰীযুক্ত ফণিভূষণ সাহা ।” ইস্কুলমাস্টার কিছুমাত্র লজ্জিত না হইয়া কহিলেন, “আমি তাহা হইলে ঠিকই অনুমান করিয়াছিলাম ; আপনার স্ত্রীর নাম কী ছিল ।” আমি কহিলাম, “নৃত্যকালী ।” as Sood দৃষ্টিদান শুনিয়াছি, আজকাল অনেক বাঙালির মেয়েকে নিজের চেষ্টায় স্বামী সংগ্ৰহ করিতে হয় । আমিও তাই করিয়াছি, কিন্তু দেবতার সহায়তায় । আমি ছেলেবেলা হইতে অনেক ব্ৰত এবং অনেক শিবপূজা করিয়াছিলাম । আমার আটবৎসর বয়স উত্তীর্ণ না হইতেই বিবাহ হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু পূৰ্ব্বজন্মের পাপবশত আমি আমার এমন স্বামী পাইয়াও সম্পূৰ্ণ পাইলাম না। মা ত্রিনয়নী আমার দুইচক্ষু লইলেন । জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত স্বামীকে দেখিয়া লইবার সুখ দিলেন না।