পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ VO?) অবশেষে উভয়ের পরামর্শক্রমে একদিন একজন ইংরাজ ডাক্তার আসিয়া আমার বাম চোখে অস্ত্ৰাঘাত করিল। দুর্বল চক্ষু সে আঘাত কাটাইয়া উঠিতে পারিল না, তাহার ক্ষীণ দীপ্তিটুকু হঠাৎ নিবিয়া গেল। তাহার পরে বাকি চোখটাও দিনে দিনে অল্পে অল্পে অন্ধকারে আবৃত হইয়া গেল । বাল্যকালে শুভদৃষ্টির দিনে যে চন্দনচর্চিত তরুণমূর্তি আমার সম্মুখে প্ৰথম প্রকাশিত হইয়াছিল তাহার উপরে চিরকালের মতো পর্দা পড়িয়া গেল । একদিন স্বামী আমার শয্যাপার্থে আসিয়া কহিলেন, “তোমার কাছে আর মিথ্যা বড়াই করিব না, তোমার চোখ-দুটি আমিই নষ্ট করিয়াছি।” দেখিলাম, তাহার কণ্ঠস্বরে অশ্রািজল ভরিয়া আসিয়াছে। আমি দুই হাতে তাহার দক্ষিণহস্ত চাপিয়া কহিলাম, “বেশ করিয়াছ, তোমার জিনিস তুমি লইয়াছ। ভাবিয়া দেখো দেখি, যদি কোনো ডাক্তারের চিকিৎসায় আমার চোখ নষ্ট হইত। তাহাতে আমার কী সাত্বনা থাকিত । ভবিতব্যতা যখন খণ্ডে না তখন চোখ তো আমার কেহই বঁাচাইতে পারিত না, সে চোখ তোমার হাতে গিয়াছে এই আমার অন্ধতার একমাত্র সুখ। যখন পূজার ফুল কম পড়িয়ছিল তখন রামচন্দ্ৰ ঠাহার দুই চক্ষু উৎপাটন করিয়া দেবতাকে দিতে গিয়াছিলেন । আমার দেবতাকে আমার দৃষ্টি দিলাম- আমার পূর্ণিমার জ্যোৎস্না, আমার প্রভাতের আলো, আমার আকাশের নীল, আমার পৃথিবীর সবুজ সব তোমাকে দিলাম ; তোমার চোখে যখন যাহা ভালো লাগিবে আমাকে মুখে বলিয়ো, সে আমি তোমার চোখের দেখার প্ৰসাদ বলিয়া গ্ৰহণ করিব ।” আমি এত কথা বলিতে পারি নাই, মুখে এমন করিয়া বলাও যায় না ; এ-সব কথা আমি অনেক দিন ধরিয়া ভাবিয়াছি । মাঝে মাঝে যখন অবসাদ আসিত, নিষ্ঠার তেজ স্নান হইয়া পড়িত, নিজেকে বঞ্চিত দুঃখিত দুৰ্ভাগ্যদগ্ধ বলিয়া মনে হইত, তখন আমি নিজের মনকে দিয়া এই সব কথা বলাইয়া লাইতাম ; এই শান্তি, এই ভক্তিকে অবলম্বন করিয়া নিজের দুঃখের চেয়েও নিজেকে উচ্চ করিয়া তুলিতে চেষ্টা করিতাম। সেদিন কতকটা কথায় কতকটা নীরবে বোধ করি আমার মনের ভাবটা তাহাকে একরকম করিয়া বুঝাইতে পারিতেছিলাম। তিনি কহিলেন, “কুমু, মৃঢ়তা করিয়া তোমার যা নষ্ট করিয়াছি সে আর ফিরাইয়া দিতে পারিব না, কিন্তু আমার যতদূর সাধ্য তোমার চোখের অভাব মোচন করিয়া তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকিব ।” আমি কহিলাম, “সে কোনো কাজের কথা নয়। তুমি যে তোমার ঘরকন্নাকে একটি অন্ধের হাসপাতাল করিয়া রাখিবে, সে আমি কিছুতেই হইতে দিব না। তোমাকে আর একটি বিবাহ করিতেই হইবে ।” কী জন্য যে বিবাহ করা নিতান্ত আবশ্যক তাহা সবিস্তারে বলিবার পূর্বে আমার একটুখানি কণ্ঠরোধ হইবার উপক্রম হইল। একটু কাশিয়া, একটু সামলাইয়া লইয়া বলিতে যাইতেছি, এমন সময় আমার স্বামী উচ্ছসিত আবেগে বলিয়া উঠিলেন, “আমি মূঢ়, আমি অহংকারী, কিন্তু তাই বলিয়া আমি পাষণ্ড নই। নিজের হাতে তোমাকে অন্ধ করিয়াছি, অবশেষে সেই দোষে তোমাকে পরিত্যাগ করিয়া যদি অন্য স্ত্রী গ্ৰহণ করি তবে আমাদের ইষ্টদেব গোপীনাথের শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি যেন ব্ৰহ্মহত্যা-পিতৃহত্যার পাতকী হই ।” এতবড়ো শপথটা করিতে দিতাম না, বাধা দিতাম, কিন্তু অশ্রু তখন বুক বাহিয়া, কণ্ঠ চাপিয়া, দুইচক্ষু ছাপিয়া, ঝরিয়া পড়িবার জো করিতেছিল; তাহাকে সংবরণ করিয়া কথা বলিতে পারিতেছিলাম না। তিনি যাহা বলিলেন তাহা শুনিয়া বিপুল আনন্দের উদবেগে বালিশের মধ্যে মুখ চাপিয়া কাদিয়া উঠিলাম। আমি অন্ধ, তবু তিনি আমাকে ছাড়িবেন না । দুঃখীর দুঃখের মতো আমাকে হৃদয়ে ধরিয়া রাখিবেন । এত সৌভাগ্য আমি চাই না, কিন্তু মন তো স্বার্থপর । অবশেষে অশ্রুর প্রথম পশলাটা সবেগে বর্ষণ হইয়া গেলে তাহার মুখ আমার বুকের কাছে টানিয়া লইয়া বলিলাম, “এমন ভয়ংকর শপথ কেন করিলে। আমি কি তোমাকে নিজের সুখের জন্য বিবাহ করিতে বলিয়াছিলাম। সতীনকে দিয়া আমি আমার স্বাের্থ সাধন করিতাম। চােখের অভাবে তােমার