পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

&9(ሉ 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ইচ্ছায় অনিচ্ছায় জ্ঞানে অজ্ঞানে ভুলে ভ্ৰান্তিতে দুঃখ সুখ নানারকম ঘটিয়া থাকে ; কিন্তু মনের মধ্যে যদি ভক্তি স্থির রাখিতে পারি। তবে দুঃখের মধ্যেও একটা শান্তি থাকে, নহিলে কেবল রাগারগি রেষারেষি বকবিকি করিয়াই জীবন কাটিয়া যায়। অন্ধ হইয়াছি। এই তো যথেষ্ট দুঃখ, তাহার পরে স্বামীর প্রতি বিদ্বেষ করিয়া দুঃখের বােঝা বাড়াইব কেন । আমার মতো বালিকার মুখে সেকেলে কথা শুনিয়া লাবণ্য রাগ করিয়া অবজ্ঞাভরে মাথা নাড়িয়া চলিয়া গেল । কিন্তু যা-ই বলি, কথার মধ্যে বিষ আছে, কথা একেবারে ব্যর্থ হয় না । লাবণ্যের মুখ হইতে রাগের কথা আমার মনের মধ্যে দুটাে-একটা স্মৃলিঙ্গ ফেলিয়া গিয়াছিল, আমি সেটা পা দিয়া মাড়াইয়া নিবাইয়া দিয়াছিলাম, কিন্তু তবু দুটা-একটা দাগ থাকিয়াছিল ; তাই বলিতেছিলাম, কলিকাতায় অনেক তর্ক, অনেক কথা ; সেখানে দেখিতে দেখিতে বুদ্ধি অকালে পাকিয়া কঠিন হইয়া উঠে । পাড়াগায়ে আসিয়া আমার সেই শিবপূজার শীতল শিউলি ফুলের গন্ধে হৃদয়ের সমস্ত আশা ও বিশ্বাস আমার সেই শিশুকালের মতোই নবীন ও উজ্জ্বল হইয়া উঠিল । দেবতায় আমার হৃদয় এবং আমার সংসার পরিপূর্ণ হইয়া গেল। আমি নতশিরে লুটাইয়া পড়িলাম। বলিলাম, “হে দেব, আমার চক্ষু গেছে বেশ হইয়াছে, তুমি তো আমার আছ ।” হয়, ভুল বলিয়াছিলাম । তুমি আমার আছ, এ কথাও স্পর্ধার কথা । আমি তোমার আছি, কেবল এইটুকু বলিবারই অধিকার আছে। ওগো, একদিন কণ্ঠ চাপিয়া আমার দেবতা এই কথাটা আমাকে বলাইয়া লইবে । কিছুই না থাকিতে পারে, কিন্তু আমাকে থাকিতেই হইবে । কাহারও উপরে কোনো কিছুকাল বেশ সুখে কাটিল। ডাক্তারিতে আমার স্বামীরও প্রতিপত্তি বাড়িতে লাগিল। হাতে কিছু प्रेकास्3 छळित । কিন্তু টাকা জিনিসটা ভালো নয় । উহাতে মন চাপা পড়িয়া যায় । মন যখন রাজত্ব করে তখন সে আপনার সুখ আপনি সৃষ্টি করিতে পারে, কিন্তু ধন যখন সুখ-সঞ্চায়ের ভার নেয়। তখন মনের আর কাজ থাকে না । তখন, আগে যেখানে মনের সুখ ছিল জিনিসপত্র আসবাব আয়োজন সেই জায়গাটুকু জুড়িয়া বসে। তখন সুখের পরিবর্তে কেবল সামগ্ৰী পাওয়া যায় । কোনো বিশেষ কথা বা বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করিতে পারি না। কিন্তু অন্ধের অনুভবশক্তি বেশি বলিয়া, কিংবা কী কারণ জানি না, অবস্থার সচ্ছলতার সঙ্গে সঙ্গে আমার স্বামীর পরিবর্তন আমি বেশ বুঝিতে পারিতাম । যৌবনারস্তে ন্যায়-অন্যায় ধর্ম-অধৰ্ম সম্বন্ধে আমার স্বামীর যে একটি বেদনাবোধ ছিল সেটা যেন প্রতিদিন অসাড় হইয়া আসিতেছিল । মনে আছে, তিনি একদিন বলিতেন, “ডাক্তারি যে কেবল জীবিকার জন্য শিখিতেছি তাহা নহে, ইহাতে অনেক গরিবের উপকার করিতে পারিব।” যে-সব ডাক্তার দরিদ্র মুমূর্ফর দ্বারে আসিয়া আগাম ভিজিট না লইয়া নাড়ি দেখিতে চায় না। তাহদের কথা বলিতে গিয়া ঘূণায় তাহার বাকরোধ হইত। আমি বুঝিতে পারি, এখন আর সে দিন নাই। একমাত্র ছেলের প্রাণরক্ষার জন্য দরিদ্র নারী তাহার পা জড়াইয়া ধরিয়াছে, তিনি তাহা উপেক্ষা করিয়াছেন ; শেষে আমি মাথার দিব্য দিয়া তাহাকে চিকিৎসায় পাঠাইয়াছি, কিন্তু মনের সঙ্গে কাজ করেন নাই । যখন আমাদের টাকা অল্প ছিল তখন অন্যায় উপার্জনকে আমার স্বামী কী চক্ষে দেখিতেন, তাহা আমি জানি । কিন্তু ব্যাঙ্কে এখন অনেক টাকা জমিয়াছে, এখন একজন ধনী লোকের আমলা আসিয়া তাহার সঙ্গে গোপনে দুইদিন ধরিয়া অনেক কথা বলিয়া গেল, কী বলিল আমি কিছুই জানি না, কিন্তু তাহার পরে যখন তিনি আমার কাছে আসিলেন, অত্যন্ত প্ৰফুল্পতার সঙ্গে অন্য নানা বিষয়ে নানা কথা বলিলেন, তখন আমার অন্তঃকরণের স্পর্শশক্তিত্বারা বুঝিলাম, তিনি আজ কলঙ্ক মাখিয়া আসিয়াছেন । অন্ধ হইবার পূর্বে আমি ধাহাকে শেষবার দেখিয়ছিলাম আমার সে স্বামী কোথায় । যিনি আমার বৃষ্টিহীন দুই চক্ষুর মাঝখানে একটি চুম্বন করিয়া আমাকে একদিন দেবীপদে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন, আমি তাহার কী করিতে পারিলাম। একদিন একটা রিপুর ঝড় আসিয়া যাহাঁদের অকস্মাৎ পতন হয়