পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

site &ዕd ዓ যে অন্ধ।” শুনিয়া সে কিছুক্ষণ আশ্চর্য হইয়া গভীর হইয়া রহিল। বেশ বুঝিতে পারিলাম, তাহার কুতুহলী তরুণ আয়ত নেত্ৰ দিয়া সে আমার দৃষ্টিহীন চক্ষু এবং মুখের ভাব মনোযোগের সহিত দেখিল ; তাহার পরে কহিল, “ওঃ, তাই বুঝি কাকিকে এখানে আনাইয়াছ ?” আমি কহিলাম, “না, আমি ডাকি নাই । তোমার কাকি আপনি আসিয়াছেন ।” বালিকা আবার হাসিয়া উঠিয়া কহিল, “দয়া করিয়া ? তাহা হইলে দয়াময়ী শীঘ্ৰ নড়িতেছেন না ! কিন্তু, বাবা আমাকে এখানে কেন পাঠাইলেন ।” এমন সময় পিসিমা ঘরে প্রবেশ করিলেন । এতক্ষণ আমার স্বামীর সঙ্গে তাহার কথাবার্তা চলিতেছিল। ঘরে আসিতেই হেমাঙ্গিনী কহিল, “কাকি, আমরা বাড়ি ফিরিব কবে বলে ।” পিসিমা কহিলেন, “ওমা ! এইমাত্র আসিয়াই অমনি যাই-যাই । অমন চঞ্চল মেয়েও তো দেখি নাই ।” হেমাঙ্গিনী কহিল, “কাকি, তোমার তো এখান হইতে শীঘ্ৰ নড়িবার গতিক দেখি না । তা, তোমার এ হল আত্মীয়ঘর, তুমি যতদিন খুশি থাকো, আমি কিন্তু চলিয়া যাইব, তা তোমাকে বলিয়া রাখিতেছি ।” এই বলিয়া আমার হাত ধরিয়া কহিল, “কী বলে ভাই, তোমরা তো আমার ঠিক আপনি নও ” আমি তাহার এই সরল প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়া তাহাকে আমার বুকের কাছে টানিয়া লইলাম । দেখিলাম, পিসিমা যতই প্ৰবলা হউন এই কন্যাটিকে তাহার সামলাইবার সাধ্য নাই । পিসিমা প্ৰকাশ্যে রাগ না দেখাইয়া হেমাঙ্গিনীকে একটু আদর করিবার চেষ্টা করিলেন ; সে তাহা যেন গা হইতে ঝাড়িয়া ফেলিয়া দিল । পিসিমা সমস্ত ব্যাপারটাকে আদুরে মেয়ের একটা পরিহাসের মতো উড়াইয়া দিয়া হাসিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন । আবার কী ভাবিয়া ফিরিয়া আসিয়া হেমাঙ্গিনীকে কহিলেন, “হিমু, চল তোর স্নানের বেলা হইল।” সে আমার কাছে আসিয়া কহিল, “আমরা দুইজনে ঘাটে যাইব, কী বলে ভাই ।” পিসিমা অনিচ্ছাসত্ত্বেও ক্ষান্ত দিলেন ; তিনি জানিতেন, টানাটানি করিতে গেলে হেমাঙ্গিনীরই জয় হইবে এবং তঁহাদের মধ্যেকার বিরোধ অশোভন রূপে আমার সম্মুখে প্ৰকাশ হইবে । খিড়কির ঘাটে যাইতে যাইতে হেমাঙ্গিনী আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার ছেলেপূলে নাই কেন ।” আমি ঈষৎ হাসিয়া কহিলাম, “কেন তাহা কী করিয়া জানিব, ঈশ্বর দেন নাই ।” হেমাঙ্গিনী কহিল, “অবশ্য, তোমার ভিতরে কিছু পাপ ছিল ।” আমি কহিলাম, “তাহাও অন্তর্যামী জানেন ।” বালিকা প্ৰমাণস্বরূপে কহিল, “দেখো-না, কাকির ভিতরে এত কুটিলতা যে উহার গর্ভে সন্তান জন্মিতে পায় না।” পাপপুণ্য সুখদুঃখ দণ্ডপুরস্কারের তত্ত্ব নিজেও বুঝি না, বালিকাকেও বুঝাইলাম না ; কেবল একটা নিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে তাহাকে কহিলাম, তুমিই জান ! হেমাঙ্গিনী তৎক্ষণাৎ আমাকে জড়াইয়া ধরিয়া হাসিয়া উঠিয়া কহিল, “ওমা, আমার কথা শুনিয়াও তোমার নিশ্বাস পড়ে ! আমার কথা বুঝি কেহ গ্রাহ্য করে ।” দেখিলাম, স্বামীর ডাক্তারি ব্যবসায়ে ব্যাঘাত হইতে লাগিল ; দূরে ডাক পড়িলে তো যানই না, কাছে কোথাও গেলেও চটপট সারিয়া চলিয়া আসেন। পূর্বে যখন কর্মের অবসরে ঘরে থাকিতেন, মধ্যাহ্নে আহার এবং নিদ্রার সময়ে কেবল বাড়ির ভিতরে আসিতেন । এখন পিসিমাও যখন-তখন ডাকিয়া পাঠান, তিনিও অনাবশ্যক পিসিমার খবর লইতে আসেন । পিসিমা যখন ডাক ছাড়িয়া বলেন "হিমু, আমার পানের বাটাটা নিয়ে আয় তো', আমি বুঝিতে পারি, পিসিমার ঘরে আমার স্বামী আসিয়াছেন । প্রথম প্রথম দিন-দুই-তিন হেমাঙ্গিনী পানের বাটা, তেলের বাটি, সিঁদুরের কীেটাে প্রভৃতি যথাদিষ্ট লইয়া যাইত । কিন্তু, তাহার পরে ডাক পড়িলে সে আর কিছুতেই নড়িত না, ঝির হাত দিয়া আদিষ্ট দ্রব্য পাঠাইয়া দিত। পিসি ডাকিতেন, ‘হেমাঙ্গিনী, হিমু, হিমি— বালিকা যেন আমার প্রতি একটা করুণার আবেগে আমাকে জড়াইয়া থাকিত ; একটা আশঙ্কা এবং বিবাদে তাহাকে আচ্ছন্ন করিত । ইহার পর হইতে আমার স্বামীর কথা সে আমার কাছে ভ্ৰমেও উল্লেখ করিত না । ইতিমধ্যে আমার দাদা আমাকে দেখিতে আসিলেন । আমি জানিতাম, দাদার দৃষ্টি তীক্ষ । ব্যাপারটা