পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vosby রবীন্দ্র-রচনাবলী কিরূপ চলিতেছে তাহা তাহার নিকট গোপন করা প্ৰায় অসাধ্য হইবে । আমার দাদা বড়ো কঠিন বিচারক । তিনি লেশমাত্র অন্যায়কে ক্ষমা করিতে জানেন না। আমার স্বামী যে তাঁহারই চক্ষের সম্মুখে অপরাধীরূপে দাড়াইবেন, ইহাই আমি সব চেয়ে ভয় করিতাম। আমি অতিরিক্ত প্ৰফুল্লতা দ্বারা সমস্ত আচ্ছন্ন করিয়া রাখিলাম । আমি বেশি কথা বলিয়া, বেশি ব্যস্তসমস্ত হইয়া, অত্যন্ত ধুমধাম করিয়া চারি দিকে যেন একটা ধুলা উড়াইয়া রাখিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু, সেটা আমার পক্ষে এমন অস্বাভাবিক যে তাহাতেই আরও বেশি ধরা পড়িবার কারণ হইল। কিন্তু, দাদা বেশি দিন থাকিতে পারিলেন না, আমার স্বামী এমনি অস্থিরতা প্ৰকাশ করিতে লাগিলেন যে, তাহা প্ৰকাশ্য রাঢ়তার আকার ধারণ করিল। দাদা চলিয়া গেলেন । বিদায় লইবার পূর্বে পরিপূর্ণ স্নেহের সহিত আমার মাথার উপর অনেকক্ষণ কম্পিত হস্ত রাখিলেন ; মনে মনে একাগ্ৰচিত্তে কী আশীর্বাদ করিলেন তাহা বুঝিতে পারিলাম ; তাহার অশ্রু আমার অশ্রুসিক্ত কপোলের উপর আসিয়া পড়িল । মনে আছে, সেদিন চৈত্রমাসের সন্ধ্যাবেলায় হাটের বারে লোকজন বাড়ি ফিরিয়া যাইতেছে । দূর হইতে বৃষ্টি লইয়া একটা ঝড় আসিতেছে, তাহারই মাটি-ভেজা গন্ধ এবং বাতাসের আর্দ্রভাব আকাশে ব্যাপ্ত হইয়াছে ; সঙ্গচু্যত সাথিগণ অন্ধকার মাঠের মধ্যে পরস্পরকে ব্যাকুল উর্ধর্বকণ্ঠে ডাকিতেছে। অন্ধের শয়নগহে যতক্ষণ আমি একলা থাকি ততক্ষণ প্ৰদীপ জ্বালানো হয় না ; পাছে শিখা লাগিয়া কাপড় ধরিয়া উঠে বা কোনো দুর্ঘটনা হয় । আমি সেই নির্জন অন্ধকার কক্ষের মধ্যে মাটিতে বসিয়া দুই হাত জুড়িয়া আমার অনন্ত অন্ধজগতের জগদীশ্বরকে ডাকিতেছিলাম, বলিতেছিলাম, "প্ৰভু, তোমার দয়া যখন অনুভব হয় না, তোমার অভিপ্ৰায় যখন বুঝি না, তখন এই অনাথ ভগ্ন হৃদয়ের হালটাকে প্ৰাণপণে দুই হাতে বক্ষে চাপিয়া ধরি ; বুক দিয়া রক্ত বাহির হইয়া যায়। তবু তুফান সামলাইতে পারি না ; আমার আর কত পরীক্ষা করিবে, আমার কতটুকুই বা বল।” এই বলিতে বলিতে অশ্রু উচ্ছসিত হইয়া উঠিল, খাটের উপর মাথা রাখিয়া কঁাদিতে লাগিলাম । সমস্ত দিন ঘরের কাজ করিতে হয় । হেমাঙ্গিনী ছায়ার মতো কাছে কাছে থাকে, বুকের ভিতরে যে অশ্রু ভরিয়া উঠে সে আর ফেলিবার অবসর পাই না। অনেক দিন পরে আজ চোখের জল বাহির হইল। এমন সময় দেখিলাম, খাট একটু নড়িল, মানুষ চলার উসখুসি শব্দ হইল এবং মুহূর্তপরে হেমাঙ্গিনী আসিয়া আমার গলা জড়াইয়া ধরিয়া নিঃশব্দে অঞ্চল দিয়া আমার চোখ মুছইয়া দিতে লাগিল । সে-যে সন্ধ্যার আরম্ভে কী ভাবিয়া কখন আসিয়া খাটেই শুইয়াছিল, আমি জানিতে পারি নাই । সে একটি প্রশ্নও করিল না, আমিও তাহাকে কোনো কথাই বলিলাম না। সে ধীরে ধীরে তাহার শীতল হস্ত আমার ললাটে বুলাইয়া দিতে লাগিল । ইতিমধ্যে কখন মেঘগর্জন এবং মুষলধারে বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝড় হইয়া গেল বুঝিতেই পারিলাম না ; বহুকাল পরে একটি সুস্নিগ্ধ শান্তি আসিয়া আমার জ্বরদাহদন্ধে হৃদয়কে জুড়াইয়া দিল । পরদিন হেমাঙ্গিনী কহিল, “কাকি, তুমি যদি বাড়ি না যাও আমি আমার কৈবর্তদাদার সঙ্গে চলিলাম, তাহা বলিয়া রাখিতেছি।” পিসিমা কহিলেন, “তাহাতে কাজ কী, আমিও কাল যাইতেছি ; একসঙ্গেই যাওয়া হইবে । এই দেখ হিমু, আমার অবিনাশ তোর জন্যে কেমন একটি মুক্ত-দেওয়া আংটি কিনিয়া দিয়াছে।” বলিয়া সগর্বে পিসিমা আংটি হেমাঙ্গিনীর হাতে দিলেন । হেমাঙ্গিনী কহিল, “এই দেখো কাকি, আমি কেমন সুন্দর লক্ষ্য করিতে পারি।” বলিয়া জানলা হইতে তাক করিয়া আংটি খিড়কি পুকুরের মাঝখানে ফেলিয়া দিল । পিসিমা রাগে দুঃখে বিস্ময়ে কণ্টকিত হইয়া উঠিলেন । আমাকে বারংবার করিয়া হাতে ধরিয়া বলিয়া দিলেন, “বউমা, এই ছেলেমানবির কথা অবিনাশকে খবরদার বলিয়ো না ; ছেলে আমার তাহা হইলে মনে দুঃখ পাইবে । মাথা খাও, বউমা ।” আমি কহিলাম, “আর বলিতে হইবে না পিসিমা, আমি কোনো কথাই বলিব না ।” পরদিনে যাত্রার পূর্বে হেমাঙ্গিনী আমাকে জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “দিদি, আমাকে মনে রাখিস ।” আমি দুই হাত বারংবার তাহার মুখে বুলাইয়া কহিলাম, “অন্ধ কিছু ভোলে না, বোন ; আমার তো জগৎ নাই, আমি কেবল মন লইয়াই আছি।” বলিয়া তাহার মাথাটা লইয়া একবার আত্মাণ করিয়া চুম্বন করিলাম। ঝরঝর করিয়া তাহার কেশরাশির মধ্যে আমার অশ্রু ঝরিয়া পড়িল ।