পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVO রবীন্দ্র-রচনাবলী অন্ধতা তোমাকে এক অনন্ত আবরণে আবৃত করিয়া রাখিয়াছে, সেখানে আমার প্রবেশ করিবার জো নাই। তুমি আমার দেবতা, তুমি আমার দেবতার ন্যায় ভয়ানক, তোমাকে লইয়া প্রতিদিন গৃহকাৰ্য করিতে পারি না । যাহাকে বকিব বাকিব, রাগ করিব, সোহাগ করিব, গহনা গড়াইয়া দিব, এমন একটি সামান্য রমণী আমি চাই ।” “আমার বুকের ভিতরে চিরিয়া দেখো ! আমি সামান্য রমণী, আমি মনের মধ্যে সেই নববিবাহের বালিকা বৈ কিছু নই ; আমি বিশ্বাস করিতে চাই, নির্ভর করিতে চাই, পূজা করিতে চাই ; তুমি নিজেকে অপমান করিয়া আমাকে দুঃসহ দুঃখ দিয়া তোমার চেয়ে আমাকে বড়ো করিয়া তুলিয়ে না- আমাকে সর্ববিষয়ে তোমার পায়ের নীচে রাখিয়া দাও।” আমি কী কী কথা বলিয়াছিলাম সে কি আমার মনে আছে। ক্ষুব্ধ সমুদ্র কি নিজের গর্জন নিজে শুনিতে পায় । কেবল মনে পড়ে বলিয়াছিলাম, “যদি আমি সতী হই তবে ভগবান সাক্ষী রহিলেন, তুমি কোনোমতেই তোমার ধর্মশপথ লঙ্ঘন করিতে পরিবে না। সে মহাপাপের পূর্বে হয় আমি বিধবা হইব, নয় হেমাঙ্গিনী বাচিয়া থাকিবে না।” এই বলিয়া আমি মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া গেলাম । যখন আমার মূর্জিা ভঙ্গ হইয়া গেল তখনো রাত্রিশেষের পাখি ডাকিতে আরম্ভ করে নাই এবং আমার স্বামী চলিয়া গেছেন । আমি ঠাকুরঘরে দ্বার রুদ্ধ করিয়া পূজায় বসিলাম । সমস্ত দিন আমি ঘরের বাহির হইলাম না। সন্ধ্যার সময়ে কালবৈশাখী ঝড়ে দালান কঁাপিতে লাগিল। আমি বলিলাম না যে, “হে ঠাকুর, আমার স্বামী এখন নদীতে আছেন, তাহাকে রক্ষা করো।' আমি কেবল একান্তমনে বলিতে লাগিলাম, “ঠাকুর, আমার অদূদ্ষ্টে যাহা হইবার তা হউক, কিন্তু আমার স্বামীকে মহাপাতক হইতে নিবৃত্ত করে । সমস্ত রাত্ৰি কাটিয়া গেল । তাহার পরদিনও আসন পরিত্যাগ করি নাই । এই অনিদ্রা-অনাহারে কে আমাকে বল দিয়াছিল জানি না, আমি পাষাণমূর্তির সম্মুখে পাষাণমূর্তির মতোই বসিয়া ছিলাম । সন্ধ্যার সময় বাহির হইতে দ্বার-ঠেলাঠেলি আরম্ভ হইল । দ্বারা ভাঙিয়া যখন ঘরে লোক প্রবেশ করিল তখন আমি মুছিত হইয়া পড়িয়া আছি। মূৰ্ছাভঙ্গে শুনিলাম, “দিদি ।” দেখিলাম, হেমাঙ্গিনীর কোলে শুইয়া আছি। মাথা নাড়িতেই তাহার নূতন চেলি খসখসে করিয়া উঠিল। হা ঠাকুর, আমার প্রার্থনা শুনিলে না। আমার স্বামীর পতন হইল। হেমাঙ্গিনী মাথা নিচু করিয়া ধীরে ধীরে কহিল, “দিদি, তোমার আশীৰ্বাদ লইতে আসিয়াছি।” প্রথম একমুহূর্ত কাঠের মতো হইয়া পরীক্ষণেই উঠিয়া বসিলাম ; কহিলাম, “কেন আশীৰ্বাদ করিব না, বোন । তোমার কী অপরাধ ।” h হেমাঙ্গিনী তাহার সুমিষ্ট উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল ; কহিল, “অপরাধ ! তুমি বিবাহ করিলে অপরাধ হয় না, আর আমি করিলেই অপরাধ ?” হেমাঙ্গিনীকে জড়াইয়া ধরিয়া আমিও হাসিলাম । মনে মনে কহিলাম, জগতে আমার প্রার্থনাই কি চূড়ান্ত । তাহার ইচ্ছাই কি শেষ নহে। যে আঘাত পড়িয়াছে সে আমার মাথার উপরেই পড়ক, কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে যেখানে আমার ধর্ম, আমার বিশ্বাস আছে, সেখানে পড়িতে দিব না । আমি যেমন ছিলাম তেমনি থাকিব । হেমাঙ্গিনী আমার পায়ের কাছে পড়িয়া আমার পায়ের ধূলা লইল । আমি কহিলাম, “তুমি চিরসৌভাগ্যবতী, চিরসুখিনী হও ।” হেমাঙ্গিনী কহিল, “কেবল আশীর্বাদ নয়, তোমার সতীর হন্তে আমাকে এবং তোমার ভগ্নীপতিকে বরণ করিয়া লইতে হইবে । তুমি তাহকে লজা করিলে চলিবে না। যদি অনুমতি কর তাহাকে অন্তঃপুরে লইয়া আসি।” আমি কহিলাম, “আনো ।” কিছুক্ষণ পরে আমার ঘরে নূতন পদশব্দ প্রবেশ করিল। সঙ্গেহ প্ৰয় শুনিলাম, “ভালো আছিস, 亨咀”