পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

free Oe আমি ত্ৰান্ত বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া পায়ের কাছে প্ৰণাম করিয়া কহিলাম, “দাদা !” হেমাঙ্গিনী কহিল, "দাদা কিসের । কান মলিয়া দাও, ও তোমার ছোটো ভগ্নীপতি ।” তখন সমস্ত বুঝিলাম। আমি জানিতাম, দাদার প্রতিজ্ঞা ছিল বিবাহ করিবেন না ; মা নাই, তাহাকে অনুনয় করিয়া বিবাহ করাইবার কেহ ছিল না। এবার আমিই র্তাহার বিবাহ দিলাম। দুই চক্ষু বাহিয়া হুহু করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, কিছুতেই থামাইতে পারি না। দাদা ধীরে ধীরে আমার চুলের মধ্যে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন ; হেমাঙ্গিনী আমাকে জড়াইয়া ধরিয়া কেবল হাসিতে লাগিল । রাত্রে ঘুম হইতেছিল না ; আমি উৎকণ্ঠিতচিত্তে স্বামীর প্রত্যাগমন প্রত্যাশা করিতেছিলাম। লজ্জা এবং নৈরাশ্য তিনি কিরূপভাবে সংবরণ করবেন, তাহা আমি স্থির করিতে পারিতেছিলাম না । অনেক রাত্রে অতি ধীরে দ্বার খুলিল । আমি চমকিয়া উঠিয়া বসিলাম । আমার স্বামীর পদশব্দ । বক্ষের মধ্যে হৃৎপিণ্ড আছাড় খাইতে লাগিল । তিনি বিছানার মধ্যে আসিয়া আমার হাত ধরিয়া কহিলেন, “তোমার দাদা আমাকে রক্ষা করিয়াছেন । আমি ক্ষণকালের মোহে পড়িয়া মরিতে যাইতেছিলাম। সেদিন আমি যখন নীেকায় উঠিয়ছিলাম, আমার বুকের মধ্যে যে কী পাথর চাপিয়াছিল তাহা অন্তৰ্যামী জানেন ; যখন নদীর মধ্যে ঝড়ে পড়িয়ছিলাম তখন প্রাণের ভয়ও হইতেছিল, সেইসঙ্গে ভাবিতেছিলাম, যদি ডুবিয়া যাই তাহা হইলেই আমার উদ্ধার হয়। মথুরগঞ্জে পৌঁছিয়া শুনিলাম, তাহার পূর্বদিনেই তোমার দাদার সঙ্গে হেমাঙ্গিনীর বিবাহ হইয়া গেছে । কী লজ্জায় এবং কী আনন্দে নৌকায় ফিরিয়াছিলাম তাহা বলিতে পারি না । এই কয়দিনে আমি নিশ্চয় করিয়া বুঝিয়াছি, তোমাকে ছাড়িয়া আমার কোনো সুখ নাই । তুমি আমার দেবী ।” আমি হাসিয়া কহিলাম, “না, আমার দেবী হইয়া কাজ নাই, আমি তোমার ঘরের গৃহিণী, আমি সামান্য নারী মাত্র ।” স্বামী কহিলেন, “আমারও একটা অনুরোধ তোমাকে রাখিতে হইবে । আমাকে আর দেবতা বলিয়া কখনো অপ্ৰতিভা করিয়ো না ।” পরদিন হুলুরব ও শঙ্খধ্বনিতে পাড়া মাতিয়া উঠিল। হেমাঙ্গিনী আমার স্বামীকে আহারে উপবেশনে প্ৰভাতে রাত্রে, নানাপ্রকারে পরিহাস করিতে লাগিল ; নির্যাতনের আর সীমা রহিল না, কিন্তু তিনি কোথায় গিয়াছিলেন, কী ঘাঁটিয়াছিল, কেহ তাহার লেশমাত্ৰ উল্লেখ করিল না । পৌষ ১৩০৫

  • MK v6 VNPfs

বিপিনকিশোর ধনীগহে জন্মিয়াছিলেন, সেইজন্য ধন যে পরিমাণে ব্যয় করিতে জানিতেন তাহার । অর্ধেক পরিমাণেও উপার্জন করিতে শেখেন নাই। সুতরাং যে গৃহে জন্ম সে গৃহে দীর্ঘকাল বাস করা ঘটিল না । সুন্দর সুকুমারমূর্তি তরুণ যুবক, গানবাজনায় সিদ্ধহস্ত, কাজকর্মেনিরতিশয় অপটু ; সংসারের পক্ষে সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। জীবনযাত্রার পক্ষে জগন্নাথদেবের রথের মতো অচল ; যেরূপ বিপুল আয়োজনে চলিতে পারেন সেরাপ আয়োজন সম্প্রতি বিপিনকিশোরের আয়ত্তাতীত । সৌভাগ্যক্রমে রাজা চিত্তরঞ্জন কোর্ট অফ ওয়ারড্রস হইতে বিষয় প্রাপ্ত হইয়া শখের থিয়েটার ফান্দিবার চেষ্টা করিতেছেন এবং বিপিনকিশোরের সুন্দর চেহারা ও গান গাহিবার ও গান তৈয়ারি করিবার ক্ষমতায় মুগ্ধ হইয়া, তাহাকে সাদরে নিজের অনুচরশ্রেণীতে ভুক্ত করিয়া লইয়াছেন।