পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

OAS রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহার কোলের উপর দুই পা তুলিয়া উর্ধবমুখে ঘুঘুটির প্রতি উৎসুক দৃষ্টিপাত করিতেছে ; বালিকা মধ্যে মধ্যে তাহার নাসিকাগ্রভাগে তর্জনী-আঘাত করিয়া লুব্ধ জন্তুর অতিরিক্ত আগ্রহ দমন করিয়া fGGetz পল্লীর নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে একটি গৃহস্থপ্রাঙ্গণের সচ্ছল শান্তির মধ্যে এই করুণাচ্ছবি এক মুহুর্তেই কান্তিচন্দ্রের হৃদয়ের মধ্যে আঁকা হইয়া গেল । বিরলপল্লব গাছটির ছায়া ও রৌদ্র বালিকার ক্ৰোড়ের উপর আসিয়া পডিয়াছে ; অদূরে আহারপরিতৃপ্ত পরিপুষ্ট গাভী আলস্যে মাটিতে বসিয়া শৃঙ্গ ও পুচ্ছ-আন্দোলনে পিঠের মাছি তাড়াইতেছে ; মাঝে মাঝে বীশের ঝাড়ে ফিস ফিস কথার মতো নূতন উত্তরবাতাসের খসি খসি শব্দ উঠিতেছে। সেদিন প্ৰভাতে নদীতীরে বনের মধ্যে যাহাকে বনশ্ৰীর মতো দেখিতে হইয়াছিল, আজ মধ্যাহ্নে নিস্তব্ধ গোষ্ঠপ্ৰাঙ্গণচ্ছায়ায় তাহাকে স্নেহবিগলিত গৃহলক্ষ্মীটির মতো দেখিতে হইল । কান্তিচন্দ্ৰ বন্দুক-হস্তে হঠাৎ এই ব্যথিত বালিকার সম্মুখে আসিয়া অত্যন্ত কুষ্ঠিত হইয়া পড়িলেন । মনে হইল, যেন বিমলাসুদ্ধ চোর ধরা পড়িলাম। পাখিটি যে আমার গুলিতে আহত হয় নাই, কোনোপ্রকারে এই কৈফিয়তটুকু দিতে ইচ্ছা হইল । কেমন করিয়া কথাটা পাড়িবেন ভাবিতেছেন এমন সময় কুটির হইতে কে ডাকিল, “সুধা ।” বালিকা যেন চমকিত হইয়া উঠিল । আবার ডাক পড়িল, “সুধা ।” তখন সে তাড়াতাড়ি পাখিটি লইয়া কুটিরমুখে চলিয়া গেল। কান্তিচন্দ্ৰ ভাবিলেন নামটি উপযুক্ত বটে । সুধা ! কান্তি তখন দলের লোকের হাতে বন্দুক রাখিয়া সদর পথ দিয়া সেই কুটিরের দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন । দেখিলেন, একটি প্রৌঢ়বয়স্ক মুণ্ডিতমুখ শান্তমূর্তি ব্ৰাহ্মণ দাওয়ায় বসিয়া হরিভক্তিবিলাস পাঠ করিতেছেন । ভক্তিমণ্ডিত তাহার মুখের সুগভীর স্নিগ্ধ প্ৰশান্ত ভাবের সহিত কান্তিচন্দ্ৰ সেই বালিকার দয়ার্ড মুখের সাদৃশ্য অনুভব করিলেন । কান্তি তাহাকে নমস্কার করিয়া কহিলেন, “তৃষ্ণা পাইয়াছে ঠাকুর, এক ঘটি জল পাইতে পারি কি ?” ব্ৰাহ্মণ তাড়াতাড়ি তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া বসাইলেন এবং ভিতর হইতে পিতলের রেকাবিতে কয়েকটি বাতাসা ও কাসার ঘটিতে জল লইয়া স্বহস্তে অতিথির সম্মুখে রাখিলেন । কান্তি জল খাইলে পর ব্ৰাহ্মণ তাহীর পরিচয় লইলেন । কান্তি পরিচয় দিয়া কহিলেন, “ঠাকুর, আপনার যদি কোনো উপকার করিতে পারি তো কৃতাৰ্থ হই ।” নবীন বাড়জ্যে কহিলেন, “বাবা, আমার আর কী উপকার করিবে । তবে সুধা বলিয়া আমার একটি কন্যা আছে, তাহার বয়স হইতে চলিল, তাহাকে একটি সৎপাত্রে দান করিতে পারিলেই সংসারের ঋণ হইতে মুক্তিলাভ করি। কাছে কোথাও ভালো ছেলে দেখি না, দূরে সন্ধান করিবার মতো সামর্থ্যও নাই ; ঘরে গোপীনাথের বিগ্ৰহ আছে, তাহাকে ফেলিয়া কোথাও যাই নাই ।” কান্তি কহিলেন, “আপনি নৌকায় আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলে পাত্র সম্বন্ধে আলোচনা করিব ।” এ দিকে কান্তির প্রেরিত চরগণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা সুধার কথা যাহাকেই জিজ্ঞাসা করিল সকলেই একবাক্যে কহিল, এমন লক্ষীস্বভাবা কন্যা আর হয় না । পরদিন নবীন বোটে উপস্থিত হইলে কান্তি র্তাহাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্ৰণাম করিলেন এবং জানাইলেন, তিনিই ব্ৰাহ্মণের কন্যাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছুক আছেন । ব্ৰাহ্মণ এই অভাবনীয় সৌভাগো রুদ্ধকণ্ঠে কিছুক্ষণ কথাই কহিতে পারিলেন না । মনে করিলেন, কিছু একটা ভ্ৰম হইয়াছে । কহিলেন, “আমার কন্যাকে তুমি বিবাহ করিবে ?” কান্তি কহিলেন, “আপনার যদি সম্মতি থাকে, আমি প্ৰস্তুত আছি ।” নবীন আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “সুধাকে ?”- উত্তরে শুনিলেন, “ই ।” নবীন স্থিরভাবে কহিলেন, “তা দেখাশোনা-” কান্তি যেন দেখেন নাই, ভান করিয়া কহিলেন, “সেই একেবারে শুভদৃষ্টির সময় ।” নবীন গদগদকণ্ঠে কহিলেন, “আমার সুধা বড়ো সুশীলা মেয়ে, রাধাবাড়া ঘরকন্নার কাজে