পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WOʻGA Ve রবীন্দ্ৰ-রচনার লী লইয়া কিছুতেই নিম্পত্তি হয় না । গীেরসুন্দর এক ছেলের বিবাহে খুব ধুমধাম করিতে চান, কিন্তু বুড়াশিবতলার সেই খোড়ো ঘরে সমন্ত ধুমধাম ব্যর্থ হইয়া যাইবে । তিনি জেদ করিলেন, তাহারই বাড়িতে বিবাহসভা হইবে । শুনিয়া মাতৃহীনা কন্যার দিদিমা কান্না জুড়িয়া দিলেন । তাহদেরও তো এক সময় সুদিন ছিল, আজ লক্ষ্মী বিমুখ হইয়াছেন বলিয়া কি সমস্ত সাধ জলাঞ্জলি দিতে হইবে, পিতৃপুরুষের মান বজায় থাকিবে না ? সে হইবে না ; আমাদের ঘর খোড়ো হউক আর যাই হউক, এইখানেই বিবাহ দিতে হইবে । নিরীহ-প্ৰকৃতি যজ্ঞেশ্বর অত্যন্ত দ্বিধায় পড়িয়া গেলেন । অবশেষে বিভূতিভূষণের চেষ্টায় কন্যাগহেই বিবাহ স্থির হইল । ইহাতে গীেরসুন্দর এবং তাহার দলবল কন্যাকর্তার উপর আরো চটিয়া গেলেন । সকলেই স্থির করিলেন, সম্পধিত দরিদ্রকে অপদস্থ করিতে হইবে । বরযাত্ৰ যাহা জোটানো হইল তাহা পল্টনবিশেষ । এ সম্বন্ধে গীেরসুন্দর ছেলের কোনো পরামর্শ লাইলেন না । বৈশাখ মাসে বিবাহের দিন স্থির হইল । যজ্ঞেশ্বর তাহার স্বল্পাবশিষ্ট যথাসর্বস্ব পণ করিয়া আয়োজন করিয়াছে। নূতন আটচালা বাধিয়াছ, পাবনা হইতে ঘি ময়দা চিনি দধি প্রভৃতি আনাইয়াছে। জ্যাঠাইমা তাহার যে গোপন পুঁজির বলে স্বগৃহেই বিবাহপ্রস্তাবে জেদ করিয়াছিলেন তাহার প্রায় শেষ পয়সাটি পর্যন্ত বাহির করিয়া দিয়াছেন । এমন সময় দুৰ্ভাগার অদৃষ্ট ক্রমে বিবাহের দুই দিন আগে হইতে প্ৰচণ্ড দুৰ্যোগ আরম্ভ হইল। ঝড় যদি-বা থামে তো বৃষ্টি থামে না, কিছুক্ষণের জন্য যদি-বা নরম পড়িয়া আসে আবার দ্বিগুণ বেগে আরম্ভ হয় । এমন বর্ষপ বিশ-পঁচিশ বছরের মধ্যে কেহ দেখে নাই । গীেরসুন্দর পূর্ব হইতেই গুটিকতক হাতি ও পালকি স্টেশনে হাজির রাখিয়াছিলেন । আশপাশের গ্রাম হইতে যজ্ঞেশ্বর হুইওয়ালা গোরুর গাড়ির জোগাড় করিতে লাগিলেন । দুদিনে গাড়োয়ানরা নড়িতে চায় না, হাতে পায়ে ধরিয়া দ্বিগুণ মূল্য কবুল করিয়া যজ্ঞেশ্বর তাহদের রাজি করিলেন । বরযান্ত্রের মধ্যে যাহাদিগকে গোরুর গাড়িতে চড়িতে হইল তাহারা চটিয়া আগুন হইল । গ্রামের পথে জল দাড়াইয়া গেছে । হাতির পা বসিয়া যায়, গাড়ির চাকা ঠেলিয়া তোলা দায় হইল । তখনো বৃষ্টির বিরাম নাই। বরযাত্ৰগণ ভিজিয়া কাদা মাখিয়া বিধিবিড়ম্বনার প্রতিশোধ কন্যাকর্তার উপর তুলিবে বলিয়া মনে মনে স্থির করিয়া রাখিল । হতভাগ্য যজেশ্বরকে এই অসাময়িক বৃষ্টির জন্য জবাবদিহি করিতে হইবে । কর সদলবলে কন্যাকর্তার কুটিরে আসিয়া পৌঁছিলেন । অভাবনীয় লোকসমাগম দেখিয়া গৃহস্বামীর বুক দমিয়া গেল । ব্যাকুল যজ্ঞেশ্বর কাহাকে কোথায় বসাইবেন ভাবিয়া পান না, কপালে করাঘাত করিয়া কেবলই বলিতে থাকেন, “বড়ো কষ্ট দিলাম, বড়ো কট দিলাম।” যে আটচালা বানাইয়াছিলেন, তাহার চারি দিক হইতে জল পড়িতেছে । বৈশাখ মাসে যে এমন শ্রাবণ্যধারা বহিবে তাহা তিনি স্বপ্নেও আশঙ্কা করেন নাই। গণ্ডগ্রামের ভদ্র অভদ্র সমন্ত লোকই যজেশ্বরকে সাহায্য করিতে উপস্থিত হইয়াছিল ; সংকীর্ণ স্থানকে তাহারা আরো সংকীর্ণ করিয়া তুলিল এবং বৃষ্টির কল্লোলের উপর তাহদের কলরব যোগ হইয়া একটা সমুদ্রমন্থনের মতো গোলমালের উৎপত্তি হইল। পত্রিীবৃদ্ধিগণ ধনী অতিথিদের সন্মাননার উপযুক্ত উপায় না দেখিয়া যাহাকে- তাহকে ক্রমাগতই জোড়হন্তে বিনয় করিয়া বেড়াইতে লাগিল । বরকে যখন অন্তঃপুরে লইয়া গেল তখন কুদ্ধ বরযাত্রীর দল রব তুলিল, তাহদের ক্ষুধা পাইয়াছে, আহার চাই। মুখ পাংশুবৰ্ণ করিয়া যজেশ্বর গলায় কাপড় দিয়া সকলকে বলিলেন, “আমার সাধ্যমত যাহা-কিছু আয়োজন করিয়ছিলাম সব জলে ভাসিয়া গেছে।” দ্রব্যসামগ্ৰী কতক পাবনা হইতে পথের মধ্যে কতক বা ভগ্নপ্রায় পাকশালায় গলিয়া গুলিয়া উনান দুলড়ীয়া গেছে। সােল উপকৃত পরিমাণ আহার্য সংগ্ৰহ করা যাইতে পারে বলবিজ্ঞা AR a