পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SObyrO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী দিতে বসে, হতভাগ্য আমি তেমনি নবীনমাধবের ভাবের উপরে হৃদয়ের সমন্ত উত্তাপ দিয়া চাপিয়া বসিলাম । আনাড়ির লেখা এমনি প্রবল বেগে সংশোধন করিতে লাগিলাম যে, প্রায় পনেরো-আনা আমারই লেখা দাড়াইল । নবীন বিস্মিত হইয়া বলে, “ঠিক এই কথাই আমি বলিতে চাই, কিন্তু বলিতে পারি না । অথচ তোমার এ-সব ভাব জোগায় কোথা হইতে ।” আমি কবির মতো উত্তর করি, “কল্পনা হইতে । কারণ, সত্য নীরব, কল্পনাই মুখরা। সত্য ঘটনা ভাবস্রোতকে পাথরের মতো চাপিয়া থাকে, কল্পনাই তাহার পথ মুক্ত করিয়া দেয় । নবীন গভীরমুখে একটুখানি ভাবিয়া কহিল, “তাই তো দেখিতেছি। ঠিক বটে।” আবার খানিকক্ষণ उादिशा दठिळ, *ठिंक ठिंक ।” পূর্বেই বলিয়াছি আমার ভালোবাসার মধ্যে একটি কাতর সংকোচ ছিল, তাই নিজের জবানিতে কোনোমতে লিখিতে পারিলাম না । নবীনকে পর্দার মতো, মাঝখানে রাখিয়া তবেই আমার লেখনী মুখ খুলিতে পারিল । লেখাগুলো যেন রসে ভরিয়া উত্তাপে ফাটিয়া উঠিতে লাগিল । নবীন বলিল, “এ তো তোমারই লেখা । তোমারই নামে বাহির করি ।” আমি কহিলাম, “বিলক্ষণ । এ তোমারই লেখা, আমি সামান্য একটু বদল করিয়াছি মাত্র ।” ক্রমে নবীনেরও সেইরূপ ধারণা জন্মিল । জ্যোতির্বিদ যেমন নক্ষত্র্যোদয়ের অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকে। আমিও যে তেমনি মাঝে মাঝে আমাদের পাশের বাড়ির বাতায়নের দিকে চাহিয়া দেখিতাম, সে কথা অস্বীকার করিতে পারি না । মাঝে মাঝে ভক্তের সেই ব্যাকুল দৃষ্টিক্ষেপ সার্থকও হইত। সেই কর্মযোগনিরতা ব্ৰহ্মচারিণীর সৌম্য মুখশ্ৰী হইতে শান্তঙ্গিন্ধ জ্যোতি প্ৰতিবিম্বিত হইয়া মুহুর্তের মধ্যে আমার সমন্ত চিত্তক্ষোভ দমন করিয়া দিত । কিন্তু সেদিন সহসা এ কী দেখিলাম। আমার চন্দ্ৰলোকেও কি এখনো অগ্নি্যুৎপাত আছে । সেখানকার জনশূন্য সমাধিমন্ত্র গিরিগুহার সমস্ত বহ্নিদাহ এখনো সম্পূর্ণ নির্বাণ হইয়া যায় নাই কি । সেদিন বৈশাখ মাসের অপরাহুে ঈশান কোণে মেঘ ঘনাইয়া আসিতেছিল । সেই আসন্ন ঝঞ্জার মেঘবিচক্ষুরিত রুদ্রদীপ্তিতে আমার প্রতিবেশিনী জানালায় একাকিনী দাড়াইয়া ছিল । সেদিন তাহার শূন্যনিবিষ্ট ঘনকৃষ্ণ দৃষ্টির মধ্যে কী সুদূরপ্রসারিত নিবিড় বেদনা দেখিতে পাইলাম । আছে, আমার ঐ চন্দ্ৰলোকে এখনো উত্তাপ আছে ! এখনো সেখানে উক নিশ্বাস সমীরিত । দেবতার জন্য মানুষ নহে, মানুষের জন্যই সে । তাহার সেই দুটি চক্ষুর বিশাল ব্যাকুলতা সেদিনকার সেই কাড়ের আলোকে ব্যগ্ৰ পাখির মতো উড়িয়া চলিয়াছিল । স্বর্গের দিকে নহে, মানবহৃদয়নীড়ের দিকে । সেই উৎসুক আকাঙ্ক্ষা-উদ্দীপ্ত দৃষ্টিপাতটি দেখার পর হইতে অশান্ত চিত্তকে সুস্থির করিয়া রাখা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হইল। তখন কেবল পরের কঁচা কবিতা সংশোধন করিয়া তৃপ্তি হয় না- একটা যে-কোনোপ্রকার কাজ করিবার জন্য চঞ্চলতা জন্মিল । তখন সংকল্প করিলাম, বাংলাদেশে বিধবাবিবাহ প্ৰচলিত করিবার জন্য আমার সমন্ত চেষ্টা প্রয়োগ করিব । কেবল বক্তৃতা ও লেখা নহে, অর্থসাহায্য করিতেও অগ্রসর হইলাম । নবীন আমার সঙ্গে তর্ক করিতে লাগিল ; সে বলিল, “চিরবৈধব্যের মধ্যে একটি পবিত্র শান্তি আছে, একাদশীর ক্ষীণ জ্যোৎস্নালোকিত সমাধিভূমির মতো একটি বিরাট রমণীয়তা আছে। বিবাহের সম্ভাবনামাত্রেই কি সেটা ভাঙিয়া যায় না ।” এ-সব কবিত্বের কথা শুনিলেই আমার রাগ হইত। দুর্ভিক্ষে যে লোক জীৰ্ণ হইয়া মরিতেছে তাহার কাছে আহরিপুষ্ট লোক যদি খাদ্যের দুলত্বের প্রতি ঘৃণা প্ৰকাশ করিয়া ফুলের গন্ধ এবং পাখির গান দিয়া মুমূৰ্বর পেট ভরাইতে চাহে তাহা হইলে সে কেমন হয় । A. আমি রাগিয়া কহিলাম, “দেখো নবীন, আর্টিস্ট লোকে বলে, দৃশ্য হিসাবে পোড়ো বাড়ির একটা