পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sbr V রবীন্দ্র-রচনাবলী বোঝে, পাছে তাহার ভালো না লাগে, এ সংকোচ সে তাড়াইতে পারিতেছিল না । আজ খাতা আনিয়া একটুখানি লাল হইয়া, একটুখানি কাশিয়া, পড়িতে আরম্ভ করিল। চারু গাছের গুড়িতে হেলান দিয়া ঘাসের উপর পা ছাড়াইয়া শুনিতে লাগিল । প্ৰবন্ধের বিষয়টা ছিল ‘আমার খাতা' । অমল লিখিয়াছিল- ‘হে আমার শুভ্ৰ খাতা, আমার কল্পনা এখনো তোমাকে স্পর্শ করে নাই । সূতিকাগৃহে ভাগ্য পুরুষ প্রবেশ করিবার পূর্বে শিশুর ললাটপটের ন্যায় তুমি নির্মল, তুমি রহস্যময় । যেদিন তোমার শেষ পৃষ্ঠার শেষ ছত্ৰে উপসংহার লিখিয়া দিব, সেদিন আজ কোথায় ! তোমার এই শুভ্ৰ শিশুপত্রগুলি সেই চিরদিনের জন্য মসীচিহ্নিত সমাপ্তির কথা আজ স্বপ্নেও কল্পনা করিতেছে না। ’- ইত্যাদি অনেকখানি লিখিয়াছিল । চারু। তরুচ্ছায়ায় বসিয়া স্তব্ধ হইয়া শুনিতে লাগিল । পড়া শেষ হইলে ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “তুমি আবার লিখতে পার না ?” সেদিন সেই গাছের তলায় অমল সাহিত্যের মাদকারস প্রথম পান করিল ; সাকী ছিল নবীনা, রসনও ছিল নবীন এবং অপরাহুের আলোক দীর্ঘ ছায়াপাতে রহস্যময় হইয়া আসিয়াছিল । চারু বলিল, “অমল, গোটকতক আমড়া পেড়ে নিয়ে যেতে হবে, নইলে মন্দাকে কী হিসেব 0भय ।” মূঢ় মন্দাকে তাহাদের পড়াশুনা এবং আলোচনার কথা বলিতে প্ৰবৃত্তিই হয় না, সুতরাং আমড়া, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ বাগানের সংকল্প তাহদের অন্যান্য অনেক সংকল্পের ন্যায় সীমাহীন কল্পনাক্ষেত্রের মধ্যে কখন হারাইয়া গেল তাহা আমল এবং চারু। লক্ষও করিতে পারিল না । এখন আমলের লেখাই তাহদের আলোচনা ও পরামর্শের প্রধান বিষয় হইয়া উঠিল । অমল আসিয়া বলে, “বোঠান, একটা বেশ চমৎকার ভাব মাথায় এসেছে ।” চারু উৎসাহিত হইয়া উঠে ; বলে, “চলো, আমাদের দক্ষিণের বারান্দায়- এখানে এখনই মন্দা পান সাজতে আসবে ।” চারু কাশ্মীরি বারান্দায় একটি জীর্ণ বেতের কেদারায় আসিয়া বসে এবং অমল রেলিন্ডের নিচেৎকার উচ্চ অংশের উপর বসিয়া পা ছাড়াইয়া দেয় । অমলের লিখিবার বিষয়গুলি প্রায়ই সুনির্দিষ্ট নহে ; তাহা পরিষ্কার করিয়া বলা শক্ত । গোলমাল করিয়া সে যাহা বলিত তাহা স্পষ্ট বুঝা কাহারও সাধা নহে। অমল নিজেই বার বার বলিত, “বোঠান, তোমাকে ভালো বোঝাতে পারছি নে ৷” চারু বলিত, “না, আমি অনেকটা বুঝতে পেরেছি ; তুমি এইটে লিখে ফেলো, দেরি কোরো না ।” সে খানিকটা বুঝিয়া, খানিকটা না বুবিয়া, অনেকটা কল্পনা করিয়া, অনেকটা আমলের ব্যক্ত করিবার আবেগের দ্বারা উত্তেজিত হইয়া, মনের মধ্যে কী একটা খাড়া করিয়া তুলিত, তাহতেই সে সুখ পাইত এবং আগ্রহে অধীর হইয়া উঠিত । চারু সেইদিন বিকালেই জিজ্ঞাসা করিত, “কতটা লিখলে ।” অমল বলিত, “এরই মধ্যে কি লেখা যায় ।” চারু পরদিন সকালে ঈষৎ কলহের স্বরে জিজ্ঞাসা করিত, “কই, তুমি সেটা লিখলে না ?” অমল বলিত, “রোসো, আর-একটু ভাবি ।” চারু রাগ করিয়া বলিত, “তবে যাও ।” বিকালে সেই রাগ ঘনীভূত হইয়া চারু যখন কথা বন্ধ করিবার জো করিত তখন অমল লেখা কাগজের একটা অংশ রুমাল বাহির করিবার ছলে পকেট হইতে একটুখানি বাহির করিত।