পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

«©brbr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অনেকক্ষণ চাককে বিরক্ত করিয়া অমল পকেট হইতে সরোরুহ-নামক বিখ্যাত মাসিক পত্র বাহির করিল। চারু দেখিল, কাগজে অমলের সেই “খাতা-নামক প্ৰবন্ধটি বাহির হইয়াছে । চারু দেখিয়া চুপ করিয়া রহিল। অমল মনে করিয়াছিল, তাহার বোঠান খুব খুশি হইবে । কিন্তু খুশির বিশেষ কোনো লক্ষণ না দেখিয়া বলিল, “সরোরুহ পত্রে যে-সে লেখা বের হয় না।” অমল এটা কিছু বেশি বলিল । যে-কোনোপ্রকার চলনসই লেখা পাইলে সম্পাদক ছাড়েন না । কিন্তু অমল চারুকে বুঝাইয়া দিল, সম্পাদক বড়োই কড়া লোক, একশো প্রবন্ধের মধ্যে একটা বাছিয়া 研R শুনিয়া চারু খুশি হইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু খুশি হইতে পারিল না। কিসে যে সে মনের মধ্যে আঘাত পাইল তাহা বুঝিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল ; কোনো সংগত কারণ বাহির হইল না । অমলের লেখা অমল এবং চারু দুজনের সম্পত্তি । অমল লেখক এবং চারু পাঠক । তাহার গোপনতাই তাহার প্রধান রস । সেই লেখা সকলে পড়িবে এবং অনেকেই প্ৰশংসা করিবে, ইহাতে চারুকে যে কেন এতটা পীড়া দিতেছিল তাহা সে ভালো করিয়া বুঝিল না। কিন্তু লেখকের আকাঙক্ষা একটিমাত্র পাঠকে অধিকদিন মেটে না । অমল তাহার লেখা ছাপাইতে আরম্ভ করিল । প্ৰশংসাও পাইল । মাঝে মাঝে ভক্তের চিঠিও আসিতে লাগিল । অমল সেগুলি তাহার বোঠানকে দেখাইত । চারু তাহাতে খুশিও হইল, কষ্টও পাইল । এখন অমলকে লেখায় প্রবৃত্ত করাইবার জন্য একমাত্র তাহারই উৎসাহ ও উত্তেজনার প্রয়োজন রহিল না । অমল মাঝে মাঝে কদাচিৎ নামস্বাক্ষরবিহীন রমণীর চিঠিও পাইতে লাগিল । তাহা লইয়া চারু তাহাকে ঠাট্টা করিত কিন্তু সুখ পাইত না । হঠাৎ তাহদের কমিটির রুদ্ধ দ্বার খুলিয়া বাংলাদেশের পাঠকমণ্ডলী তাহদের দুজনকার মাঝখানে আসিয়া দাড়াইল । ভূপতি একদিন অবসরকালে কহিল, “তাই তো চারু, আমাদের অমল যে এমন ভালো লিখতে পারে তা তো আমি জানতুম না ।” ভূপতির প্রশংসায় চারু খুশি হইল । অমল ভূপতির আশ্ৰিত, কিন্তু অন্য আশ্রিতদের সহিত তাহার অনেক প্ৰভেদ আছে। এ কথা তাহার স্বামী বুঝিতে পারিলে চারু যেন গর্ব অনুভব করে । তাহার ভাবটা এই যে ‘অমলকে কেন যে আমি এতটা স্নেহ আদর করি এতদিনে তোমরা তাহা বুঝিলে ; আমি অনেকদিন আগেই অমলের মর্যাদা বুঝিয়েছিলাম, অমল কাহারও অবজ্ঞার পাত্র নহে ।" । চারু জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি তার লেখা পড়েছ ?” ভূপতি কহিল, “ই- না ঠিক পড়ি নি । সময় পাই নি । কিন্তু আমাদের নিশিকান্ত পাডে খুব প্ৰশংসা করছিল । সে বাংলা লেখা বেশ বোক্যে ।” ভূপতির মনে আমলের প্রতি একটি সম্মানের ভাব জাগিয়া উঠে, ইহা চারুর একান্ত ইচ্ছা । তৃতীয় পরিচ্ছেদ উমাপদ ভূপতিকে তাহার কাগজের সঙ্গে অন্য পাচরকম উপহার দিবার কথা বুঝাইতেছিল । উপহারে যে কী করিয়া লোকসান কাটাইয়া লাভ হইতে পারে তাহা ভূপতি কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছিল না । চারু একবার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই উমাপদকে দেখিয়া চলিয়া গেল। আবার কিছুক্ষণ ঘূরিয়া ফিরিয়া ঘরে আসিয়া দেখিল, দুইজনে হিসাব লইয়া তর্কে প্রবৃত্ত । উমাপদ চারুর অধৈৰ্য দেখিয়া কোনো দুতা করিয়া বাহির হইয়া গেল। ভূপতি হিসাব লইয়া মাথা ঘুরাইতে লাগিল ।