পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se SS চতুর্থ পরিচ্ছেদ পাঠকসমাজে প্রতিপত্তি লাভ করিয়া অমল এখন মাথা তুলিয়া উঠিয়াছে। আগে সে স্কুলের ছাত্রটির মতো থাকিত, এখন সে যেন সমাজের গণ্যমান্য মানুষের মতো হইয়া উঠিয়াছে । মাঝে মাঝে সভায় সাহিত্যপ্ৰবন্ধ পাঠ করে- সম্পাদক ও সম্পাদকের দূত তাহার ঘরে আসিয়া বসিয়া থাকে, তাহাকে নিমন্ত্ৰণ করিয়া খাওয়ায়, নানা সভার সভ্য ও সভাপতি হইবার জন্য তাহার নিকট অনুরোধ আসে, ভূপতির ঘরে দাসদাসী-আত্মীয়স্বজনের চক্ষে তাহার প্রতিষ্ঠাস্থান অনেকটা উপরে উঠিয়া মন্দাকিনী এতদিন তাহাকে বিশেষ একটা কেহ বলিয়া মনে করে নাই । অমল ও চারুর হাস্যালাপ-আলোচনাকে সে ছেলেমানুষি বলিয়া উপেক্ষা করিয়া পান সাজিত ও ঘরের কাজকর্ম করিত ; নিজেকে সে উহাদের চেয়ে শ্ৰেষ্ঠ এবং সংসারের পক্ষে আবশ্যক বলিয়াই জানিত । অমলের পান খাওয়া অপরিমিত ছিল । মন্দার উপর পান সাজিবার ভার থাকাতে সে পানের অযথা অপব্যয়ে বিরক্ত হইত। অমলে চারুতে ষড়যন্ত্ৰ করিয়া মন্দার পানের ভাণ্ডার প্রায়ই লুঠ করিয়া আনা তাহদের একটা আমোদের মধ্যে ছিল। কিন্তু এই শৌখিন চোর দুটির চৌর্ষপরিহাস মন্দার কাছে আমোদজনক বোধ হইত না । আসল কথা, একজন আশ্ৰিত অন্য আশ্রিতকে প্রসন্নচক্ষে দেখে না। অমলের জন্য মন্দাকে যেটুকু গৃহকর্ম অতিরিক্ত করিতে হইত। সেটুকুতে সে যেন কিছু অপমান বোধ করিত । চারু অমলের পক্ষপাতী ছিল বলিয়া মুখ ফুটিয়া কিছু বলিতে পারিত না, কিন্তু অমলকে অবহেলা করিবার চেষ্টা তাহার সর্বদাই ছিল । সুযোগ পাইলেই দাসদাসীদের কাছেও গোপনে অমলের নামে খোচা দিতে সে ছাড়িত না । তাহারাও যোগ দিত । কিন্তু অমলের যখন অভ্যুথান আরম্ভ হইল তখন মন্দার একটু চমক লাগিল। সে অমল এখন আর নাই । এখন তাহার সংকুচিত নম্রতা একেবারে ঘুচিয়া গেছে । অপরকে অবজ্ঞা করিবার অধিকার এখন যেন তাহারই হাতে । সংসারে প্রতিষ্ঠা প্রাপ্ত হইয়া যে পুরুষ অসংশয়ে অকুষ্ঠিতভাবে নিজেকে প্রচার করিতে পারে, যে লোক একটা নিশ্চিত অধিকার লাভ করিয়াছে, সেই সমর্থ পুরুষ সহজেই নারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে । মন্দা যখন দেখিল অমল চারি দিক হইতেই শ্ৰদ্ধা পাইতেছে তখন সেও অমলের উচ্চ মন্তকের দিকে মুখ তুলিয়া চাহিল। অমলের তরুণ মুখে নবগীেরকের গর্বোিজল দীপ্তি মন্দার চক্ষে মোহ আনিল ; সে যেন অমলকে নূতন করিয়া দেখিল । এখন আর পান চুরি করিবার প্রয়োজন রহিল না । অমলের খ্যাতিলাভে চারুর এই আর-একটা লোকসান ; তাহদের ষড়যন্ত্রের কৌতুকবন্ধন টুকু বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল ; পান এখন আমলের কাছে আপনি আসিয়া পড়ে, কোনো অভাব হয় না । তাহা ছাড়া, তাহাদের দুইজনে, গঠিত দল হইতে মন্দাকিনীকে নানা কৌশলে দূরে রাখিয়া তাহারা যে আমোদ বোধ করিত, তাহাও নষ্ট হইবার উপক্রম হইয়াছে । মন্দাকে তফাতে রাখা কঠিন হুইল । অমল যে মনে করিবে চারুই তাহার একমাত্র বন্ধু ও সমাজদার, ইহা মন্দার ভালো লাগিতা না। পূর্বকৃত অবহেলা সে সুদে আসলে শোধ দিতে উদ্যত । সুতরাং অমলে চারুতে মুখোমুখি হইলেই মন্দা কোনো ছলে মাঝখানে আসিয়া ছায়া ফেলিয়া গ্ৰহণ লাগাইয়া দিত। হঠাৎ মন্দার এই পরিবর্তন লইয়া চারু তাহার অসাক্ষাতে যে পরিহাস করিবে সে অবসর টুকু পাওয়া শক্ত হইল । মন্দার এই অনাহুত প্ৰবেশ চারুর কাছে যত বিরক্তিকর বোধ হইত অমলের কাছে ততটা বোধ হয় নাই, এ কথা বলা বাহুল্য। বিমুখ রমণীর মন ক্রমশ তাহার দিকে যে ফিরিতেছে, ইহাতে ভিতরে ভিতরে সে একটা আগ্রহ অনুভব করিতেছিল । কিন্তু চারু যখন দূর হইতে মন্দাকে দেখিয়া তীব্ৰ মৃদুঘরে বলিত “ঐ আসছেন।” তখন আমলাও বলিত, “তই তো, জ্বালালে দেখছি।” পৃথিবীর অন্য-সকল সঙ্গের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্ৰকাশ করা