পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SN 9 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী চারু । আর আমার হাতে বুঝি মারের অত্র নেই ? সেইরূপ কথা হইল। দুই সম্পাদক, দুই লেখক এবং দুই পাঠকে মিলিয়া কমিটি বসিল । অমল কহিল, “কাগজের নাম দেওয়া যাক চারুপাঠ ।” চারু কহিল, “না, এর নাম অমলা ।” এই নূতন বন্দোবস্তে চারু মাঝের কয়দিনের দুঃখবিরক্তি ভুলিয়া গেল। তাহদের মাসিক পত্রটিতে তো মন্দার প্রবেশ করিবার কোনো পথ নাই এবং বাহিরের লোকেরও প্রবেশের দ্বার রুদ্ধ । সপ্তম পরিচ্ছেদ ভূপতি একদিন আসিয়া কহিল, “চারু, তুমি যে লেখিকা হয়ে উঠবে, পূর্বে এমন তো কোনো কথা क्ति ना ।" চারু চমকিয়া লাল হইয়া উঠিয়া কহিল, “আমি লেখিকা ! কে বললে তোমাকে । কখখনো না ।” ভূপতি । বামাল সুদ্ধ গ্রেফতার। প্রমাণ হাতে-হাতে । বলিয়া ভূপতি একখণ্ড সরোরুহ বাহির করিল । চারু দেখিল, যে-সকল লেখা সে তাহদের গুপ্ত সম্পত্তি মনে করিয়া নিজেদের হস্তলিখিত মাসিক পত্রে সঞ্চয় করিয়া রাখিতেছিল তাহাই লেখক-লেখিকার নামসুদ্ধ সরোরুহে প্ৰকাশ হইয়াছে । কে যেন তাহার খাচার বডো সাধের পোষা পাখিগুলিকে দ্বার খুলিয়া উড়াইয়া দিয়াছে, এমনি তাহার মনে হইল ; ভূপতির নিকটে ধরা পড়িবার লজ্জা ভুলিয়া গিয়া বিশ্বাসঘাতী আমলের উপর তাহার মনে মনে অত্যন্ত রাগ হইতে লাগিল । “আর এইটে দেখো দেখি ” বলিয়া বিশ্ববন্ধু খবরের কাগজ খুলিয়া ভূপতি চারুর সম্মুখে ধারিল । তাহাতে ‘হাল বাংলা লেখার ঢঙে বলিয়া একটা প্ৰবন্ধ বাহির হইয়াছে । চারু, হাত দিয়া ঠেলিয়া দিয়া কহিল, “এ পড়ে আমি কী করব ।” তখন আমলের উপর অভিমানে আর কোনো দিকে সে মন দিতে পারিতেছিল না ! ভূপতি জোর করিয়া কহিল, “একবার পডে দেখোই-না ।” চারু অগত্যা চোখ বুলাইয়া গেল । আধুনিক কোনো কোনো লেখকশ্রেণীর ভাবাড়ম্বরে পূর্ণ গদ্য লেখাকে গালি দিয়া লেখক খুব কড়া প্ৰবন্ধ লিখিয়াছে । তাহার মধ্যে আমল এবং মন্মথ দত্তর লেখার ধারাকে সমালোচক তীব্ৰ উপহাস করিয়াছে, এবং তাহারই সঙ্গে তুলনা করিয়া নবীনা লেখিকা শ্ৰীমতী চারুবালার ভাষার অকৃত্রিম সরলতা, অনায়াস সরসতা এবং চিত্ররচনানৈপুণ্যের বহুল প্ৰশংসা করিয়াছে । লিখিয়াছে, এইরূপ রচনাপ্ৰণালীর অনুকরণ করিয়া সফলতা লাভ করিলে তবেই অমল-কোম্পানির নিস্তার, নচেৎ তাহারা সম্পূৰ্ণ ফেল করিবে ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই । ভূপতি হাসিয়া কহিল, “একেই বলে গুরুমারা বিদ্যে ।” চারু তাহার লেখার এই প্ৰথম প্ৰশংসায় এক-একবার খুশি হইতে গিয়া তৎক্ষণাৎ পীড়িত হইতে লাগিল । তাহার মন যেন কোনোমতেই খুশি হইতে চাহিল না। প্রশংসার লোভনীয় সুধাপাত্র মুখের কাছ পর্যন্ত আসিতেই ঠেলিয়া ফেলিয়া দিতে লাগিল । সে বুঝিতে পারিল, তাহার লেখা কাগজে ছাপাইয়া অমল হঠাৎ তাহাকে বিস্মিত করিয়া দিবার সংকল্প করিয়াছিল । অবশেষে ছাপা হইলে পর স্থির করিয়াছিল কোনো-একটা কাগজে প্ৰশংসাপূর্ণ সমালোচনা বাহির হইলে দুইটা একসঙ্গে দেখাইয়া চারুর রোবশান্তি ও উৎসাহবিধান করিবে । যখন প্ৰশংসা বাহির হইল তখন আমল কোন আগ্রহের সহিত তাহাকে দেখাইতে আসিল না । এ সমালোচনায় অমল আঘাত পাইয়াছে এবং চারুকে দেখাইতে চাহে না বলিয়াই এ কাগজগুলি সে একেবারে গোপন করিয়া গেছে । চারু আরামের জন্য অতি নিভৃতে যে একটি ক্ষুদ্র সাহিত্যনীড় রচনা করিতেছিল। হঠাৎ প্ৰশংসা-শিলাবৃষ্টির একটা বড়ো রকমের শিলা আসিয়া সেটাকে একেবারে স্বলিত করিবার জো করিল । চারুর ইহা একেবারেই ভালো লাগিল না । ভূপতি চলিয়া গেলে চারু তাহার শোবার ঘরের খাটে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল ; সম্মুখে সরোরুহ এবং বিশ্ববন্ধু খোলা পড়িয়া আছে ।