পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S&br রবীন্দ্র-রচনাবলী চীৎকার করিয়া বলিয়া আসিতে ইচ্ছা করিল। কিন্তু না বলিয়া সক্রোধ পদশব্দে তাহা প্রচার করিয়া আসিল । শয়নগৃহে প্ৰবেশ করিয়া চারু জ্বার সশব্দে বন্ধ করিল। অমল ক্ষণকালের জন্য পড়ায় ক্ষান্ত দিল । মন্দা হাসিয়া চারুর উদ্দেশে ইঙ্গিত করিল । অমল মনে মনে কহিল, ‘বউঠানের এ কী দৌরাত্মা । তিনি কি ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন, আমি তাহারই ক্রীতদাস । তাহাকে ছাড়া আর কাহাকেও পড়া শুনাইতে পারিব না । এ যে ভয়ানক জুলুম ” এই ভাবিয়া সে আরো উচ্চৈঃস্বরে মন্দাকে পিডিয়া শুনাইতে লাগিল । পড়া হইয়া গেলে চারুর ঘরের সম্মুখ দিয়া সে বাহিরে চলিয়া গেল। একবার চাহিয়া দেখিল, ঘরের ସତ୍ତ୍ଵ fr | চারু পদশব্দে বুঝিল, অমল তাহার ঘরের সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেল- একবারও থামিল না। রাগে ক্ষোভে তাহার কান্না আসিল না । নিজের নূতন-লেখা খাতাখানি বাহির করিয়া তাহার প্রত্যেক পাতা বসিয়া বসিয়া টুকরা টুকরা করিয়া ছিডিয়া তৃপাকার করিল। হায়, কী কুক্ষণেই এই-সমস্ত লেখালেখি আরম্ভ হইয়াছিল । অষ্টম পরিচ্ছেদ সন্ধ্যার সময় বারান্দার টব হইতে জুইফুলের গন্ধ আসিতেছিল । ছিন্ন মেঘের ভিতর দিয়া স্নিগ্ধ আকাশে তারা দেখা যাইতেছিল । আজ চারু চুল বাধে নাই, কাপড় ছাডে নাই। জানলার কাছে অন্ধকারে বসিয়া আছে, মৃদুবাতাসে আন্তে আন্তে তাহার খোলা চুল উড়াইতেছে, এবং তাহার চোখ দিয়া এমন ঝর ঝর করিয়া কেন জল বহিয়া যাইতেছে তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিতেছে না । এমন সময় ভূপতি ঘরে প্রবেশ করিল । তাহার মুখ অত্যন্ত স্নান, হৃদয় ভারাক্রান্ত । ভূপতির আসিবার সময় এখন নহে । কাগজের জন্য লিখিয়া প্রফ দেখিয়া অন্তঃপুরে আসিতে প্রায়ই তাহার বিলম্ব হয় । আজি সন্ধ্যার পরেই যেন কোন সান্তনা-প্রত্যাশায় চারুর নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইল । ঘরে প্রদীপ জ্বলিতেছিল না । খোলা জানলার ক্ষীণ আলোকে ভূপতি চারুকে বাতায়নের কাছে অস্পষ্ট দেখিতে পাইল ; ধীরে ধীরে পশ্চাতে আসিয়া দাড়াইল । পদশব্দ শুনিতে পাইয়াও চারু মুখ ফিরাইল না- মূর্তিটির মতো স্থির হইয়া কঠিন হইয়া বসিয়া রহিল । ভূপতি কিছু আশ্চর্য হইয়া ডাকিল, “চারু ।” ভূপতির কণ্ঠস্বরে সচকিত হইয়া তাড়াতাডি উঠিয়া পড়িল । ভূপতি আসিয়াছে সে তাহা মনে করে নাই ; ভূপতি চারুর মাথার চুলের মধ্যে আঙুল বুলাইতে বুলাইতে স্নেহার্ভকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “অন্ধকারে তুমি যে একলাটি বসে আছ, চারু ? মন্দা কোথায় গেল।” চারু যেমনটি আশা করিয়াছিল আজ সমস্ত দিন তুহার কিছুই হইল না । সে নিশ্চয় স্থির করিয়াছিল অমল আসিয়া ক্ষমা চাহিবে- সেজন্য প্ৰস্তুত হইয়া সে প্রতীক্ষা করিতেছিল, এমন সময় ভূপতির অপ্ৰত্যাশিত কণ্ঠস্বরে সে যেন আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না- একেবারে কাদিয়া ফেলিল । ভূপতি ব্যস্ত হইয়া ব্যথিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “চারু, কী হয়েছে, চারু ।” কী হইয়াছে তাহা বলা শক্ত । এমনই কী হয়েছে। বিশেষ তো কিছুই হয় নাই । অমল নিজের নূতন লেখা প্ৰথমে তাহাকে না শুনাইয়া মন্দাকে শুনাইয়াছে। এ কথা লইয়া ভূপতির কাছে কী নালিশ করিবে ! শুনিলে কি ভূপতি হাসিবে না ? এই তুচ্ছ ব্যাপারের মধ্যে গুরুতর ন্যালিশের বিষয় যে কোনখানে লুকাইয়া আছে তাহা খুঁজিয়া বাহির করা চারুর পক্ষে অসাধ্য । অকারণে সে যে কেন এত অধিক কষ্ট পাইতেছে, ইহাই সম্পূৰ্ণ বুঝিতে না পারিয়া তাহার কষ্ট্রের বেদনা আরো বাড়িয়া উঠিয়াছে। ভূপতি । বলো-না চারু, তোমার কী হয়েছে। আমি কি তোমার উপর কোনো অন্যায় করেছি। তুমি তো জানাই, কাগজের ঝঞ্জাট নিয়ে আমি কিরকম ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছি, যদি তোমার মনে কোনো আঘাত দিয়ে থাকি সে আমি ইচ্ছে করে দিই নি ।