পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 ՀԵ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী পটল ঘরকন্নার কােজ সারিয়া কুড়ানির সন্ধান লাইতে আসিয়া দেখিল, সে যতীনের পরিত্যক্ত ঘরে তাহার খাটের খুরা ধরিয়া মাটিতে পড়িয়া আছে- শূন্য শয্যাটাকে যেন পায়ে ধরিয়া সাধিতেছে। তাহার বুকের ভিতরে যে একটি সুধার পাত্র লুকানো ছিল সেইটে যেন শূন্যতার চরণে বৃথা আশ্বাসে উপুড় করিয়া ঢালিয়া দিতেছে- ভূমিতলে পুঞ্জীভূত সেই স্বলিতকেশী লুষ্ঠিতবসনা নায়ী যেন নীরব একাগ্রতার ভাষায় বলিতেছে, “লও, লও, আমাকে লাও । ওগো, আমাকে লাও ।” পটল বিস্মিত হইয়া কহিল, “ও কী হইতেছে, কুড়ানি ।” কুড়ানি উঠিল না ; সে যেমন পড়িয়ছিল তেমনি পড়িয়া রহিল। পটল কাছে আসিয়া তাহাকে স্পর্শ করিতেই সে উচ্ছসিত হইয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কঁাদিতে লাগিল । পটল তখন চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “ও পোড়ারমুখি, সর্বনাশ করিয়াছিস । মরিয়াছিস ।” হরকুমারকে পটল কুড়ানির অবস্থা জানাইয়া কহিল, “এ কী বিপদ ঘটিল। তুমি কী করিতেছিলে, তুমি আমাকে কেন বারণ করিলে না।” হরকুমার কহিল, “তোমাকে বারণ করা যে আমার কোনোকালে অভ্যাস নাই। বারণ করিলেই কি ফল পাওয়া যাইত ।” পটল । তুমি কেমন স্বামী ? আমি যদি ভুল করি, তুমি আমাকে জোর করিয়া থামাইতে পার না ? আমাকে তুমি এ খেলা খেলিতে দিলে কেন । এই বলিয়া সে চুটিয়া গিয়া ভূপতিতা বালিকার গলা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “লক্ষ্মী বোন আমার, তোর কী বলিবার আছে, আমাকে খুলিয়া বল ।” হয়, কুড়ানির এমন কী ভাষা আছে যে, আপনার হৃদয়ের অব্যক্ত রহস্য সে কথা দিয়া বলিতে পারে । সে একটি অনির্বাচনীয় বেদনার উপর তাহার সমন্ত বুক দিয়া চাপিয়া পড়িয়া আছে- সে বেদনােটা কী, জগতে এমন আর কাহারও হয় কি না, তাহাকে লোকে কী বলিয়া থাকে, কুড়ানি তাহার কিছুই জানে না । সে কেবল কান্না দিয়া বলিতে পারে ; মনের কথা জানাইবার তাহার আর কোনো ऐeeाग्न क्रा३ । পটল কহিল, “কুড়ানি, তোর দিদি বড়ো দুটি ; কিন্তু তার কথা যে তুই এমন করিয়া বিশ্বাস করিবি, তা সে কখনো মনেও করে নি । তার কথা কেহ কখনো বিশ্বাস করে না ; তুই এমন ভুল কেন করিলি । কুড়ানি, একবার মুখ তুলিয়া তোর দিদির মুখের দিকে চা ; তাকে মাপ কর।” কিন্তু, কুড়ানির মন তখন বিমুখ হইয়া গিয়াছিল, সে কোনোমতেই পটলের মুখের দিকে চাহিতে পারিল না ; সে আরো জোর করিয়া হাতের মধ্যে মাথা গুজিয়া রহিল । সে ভালো করিয়া সমস্ত কথা না বুঝিয়াও একপ্রকার মৃঢ়ভাবে পটলের প্রতি রাগ করিয়াছিল। পটল তখন ধীরে ধীরে বাহপাশ খুলিয়া লইয়া উঠিয়া গেল— এবং জানালার ধারে পাথরের মূর্তির মতো স্তৰূভাবে দাড়াইয়া ফায়ুনের রৌদ্রাচিৰুণ সুপারিগাছের পল্লবশ্রেণীর দিকে চাহিয়া পটলের দুই চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল । পরদিন কুড়ানির আর দেখা পাওয়া গেল না । পটল তাহাকে আদর করিয়া ভালো ভালো গহনা এবং কাপড় দিয়া সাজাইত । নিজে সে এলোমেলো ছিল, নিজের সাজ সম্বন্ধে তাহার কোনো যত্ন ছিল না, কিন্তু সাজগোজের সমন্ত শখ কুড়ানির উপর দিয়াই সে মিটাইয়া লইত । বহুকালসঞ্চিত সেই-সমস্ত বসনভূষণ কুড়ানির ঘরের মেজের উপর পড়িয়া আছে । তাহার হাতের বালা চুডি, নাসান্ত্রের লবঙ্গফুলটি পর্যন্ত সে খুলিয়া ফেলিয়া গিয়াছে। তাহার পটালদিদির এতদিনের সমস্ত আদর সে যেন গা হইতে মুছিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিয়াছে । হরকুমারবাবু কুড়ানির সন্ধানে পুলিসে খবর দিলেন । সেবারে প্লেগ-দমনের বিভীষিকায় এত লোক এত দিকে পলায়ন করিতেছিল যে, সেই-সকল পলাতক দলের মধ্য হইতে একটি বিশেষ লোককে বাছিয়া লওয়া পুলিসের পক্ষে শক্ত হইল। হরকুমারবাবু দুই-চারিবার ভুল লোকের সন্ধানে অনেক দুঃখ এবং লাজ পাইয়া কুড়ানির আশা পরিত্যাগ করিলেন । অজ্ঞাতের কোল হইতে তাহারা যাহাকে পাইয়াছিলেন অজ্ঞাতের কোলের মধ্যেই সে আবার লুকাইয়া পড়িল ।