পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 \98 রবীন্দ্র-রচনাবলী সাধ্যসাধনা করিতেছে। চালচলনে বাবুয়ানা ফুটিয়া উঠিয়াছে। এখন তাহার উপযুক্ত বন্ধুবান্ধবেরও অভাব নাই। কোনোগ্রাফে থিয়েটারের নটীদের ইতর গান বাজাইয়া সে বন্ধুমহলকে আমোদে রাখে । পড়িবার ঘরে সেই সাবেক ভাঙা চৌকি ও দাগি টেবিল কোথায় গেল। আয়নাতে, ছবিতে, আসবাবে ঘর যেন ছাতি ফুলাইয়া রহিয়াছে। বেণু এখন কলেজে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় বাৰ্ষিকের সীমানা পার হইবার জন্য তাহার কোনো তাগিদ দেখা যায় না । বাপ স্থির করিয়া আছেন, দুই-একটা পাস করাইয়া লইয়া বিবাহের হাটে ছেলের বাজারদার বাড়াইয়া তুলিবেন । কিন্তু ছেলের মা জানিতেন ও স্পষ্ট করিয়া বলিতেন, “আমার বেণুকে সামান্য লোকের ছেলের মতো গৌরব প্রমাণ করিবার জন্য পাসের হিসাব দিতে হইবোমা- লোহার সিন্দুকে কোম্পানির কাগজ অক্ষয় হইয়া থাক।” ছেলেও মাতার এ কথাটা বেশ করিয়া মনে মনে বুঝিয়া লইয়াছিল। যাহা হউক, বেণুর পক্ষে সে যে আজ নিতান্তই অনাবশ্যক তাহা হরলাল স্পষ্টই বুঝিতে পারিল এবং কেবলই থাকিয়া থাকিয়া সেই দিনের কথা মনে পড়িল, যেদিন বেণু হঠাৎ সকালবেলায় তাহার সেই মেসের বাসায় গিয়া তাহাব গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিয়াছিল ‘মাস্টারমশায় আমাদের বাড়ি চলো” । সে বেণু নাই, সে বাড়ি নাই, এখন মাস্টারমশায়কে কেই-বা ডাকিবে । হরলাল মনে করিয়াছিল, এইবার বেণুকে তাহদের বাসায় মাঝে মাঝে নিমন্ত্ৰণ করিবে । কিন্তু তাহাকে আহবান করিবার জোর পাইল না । একবার ভাবিল, উহাকে আসিতে বলিব ; তাহার পরে ভাবিল, বলিয়া লাভ কী- বেণু হয়তো নিমন্ত্রণ রক্ষা করিবে, কিন্তু, থাক । হরলালের মা ছাড়িলেন না । তিনি বার বার বলিতে লাগিলেন, তিনি নিজের হাতে রাধিয়া তাহাকে খাওয়াইবেন- আহা, বাছার মা মারা গেছে । অবশেষে হরলাল একদিন তাহাকে নিমন্ত্ৰণ করিতে গেল ! কহিল, “অধরবাবুর কাছ হইতে অনুমতি লইয়া আসি ।” বেণু কহিল, “অনুমতি লাইতে হইবে না, আপনি কি মনে করেন। আমি এখনো সেই খোকাবাবু আছি।” হরলালের বাসায় বেণু খাইতে আসিল । মা এই কার্তিকের মতো ছেলেটিকে তাহার দুই স্নিগ্ধচক্ষুর আশীর্বাদে অভিষিক্ত করিয়া যত্ন করিয়া খাওয়াইলেন । তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, আহা, এই বয়সের এমন ছেলেকে ফেলিয়া ইহার মা যখন মরিল তখন তাহার প্রাণ না জানি কেমন করিতেছিল । আহার সারিয়াই বেণু কহিল, “মাস্টারমশায়, আমাকে আজ একটু সকাল-সকাল যাইতে হইবে । আমার দুই-একজন ’বন্ধুর আসিবার কথা আছে।” বলিয়া পকেট হইতে সোনার ঘড়ি খুলিয়া একবার সময় দেখিয়া লইল ; তাহার পরে সংক্ষেপে বিদায় লইয়া জুড়িগড়িতে চড়িয়া বসিল । হরলাল তাহার বাসার দরজার কাছে দাড়াইয়া রহিল। গাড়ি সমস্ত গলিকে কঁপাইয়া দিয়া মুহুর্তের মধ্যেই চোখের বাহির হইয়া গেল । মা কহিলেন, “হরলাল, উহাকে মাঝে মাঝে ডাকিয়া আনিস। এই বয়সে উহার মা মারা গেছে মনে করিলে আমার প্রাণীটা কেমন করিয়া উঠে ।” হরলাল চুপ করিয়া রহিল। এই মাতৃহীন ছেলেটিকে সান্তনা দিবার জন্য সে কোনো প্রয়োজন বোধ করিল না। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে কহিল, ‘বাস, এই পর্যন্ত । আর কখনো ডাকিব না। একদিন পাচ টাকা মাইনের মাস্টারি করিয়াছিলাম বটে- কিন্তু আমি সামান্য হরলাল মাত্র ' yr একদিন সন্ধ্যার পর হরলাল আপিস হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, তাহার একতলার ঘরে অন্ধকারে কে একজন বসিয়া আছে। সেখানে যে কোনো লোক আছে তাহা লক্ষ্য না করিয়াই সে বোধ হয় উপরে উঠিয়া যাইত, কিন্তু দরজায় ঢুকিয়াই দেখিল এসেলের গন্ধে আকাশ পূর্ণ। ঘরে প্রবেশ করিয়া হরলাল জিজ্ঞাসা করিল, “কে, মশায়।” বেণু বলিয়া উঠিল, “মাস্টারমশায়, আমি।”