পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Ney রবীন্দ্র-রচনাবলী এমন সময় হরলালের জন্য যে জলখাবার প্রস্তুত ছিল তাঁহাই বেণুর জন্য থালায় গুছাইয়া মা তাহাদের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কহিলেন, “কোথায় যাও, বাছা।” মা কহিলেন, “সে কি হয় বাছা, কিছু না খাইয়া যাইতে পরিবে না।” এই বলিয়া সেই বারান্দায় পাত পাড়িয়া তাহাকে হাতে ধরিয়া খাইতে বসাইলেন । বেণু। রাগ করিয়া কিছু খাইতেছে না, খাবার লইয়া একটু নাড়াচাড়া করিতেছে মাত্র, এমন সময় দরজার কাছে একটা গাড়ি আসিয়া থামিল। প্ৰথমে একটা দরোয়ান ও তাহার পশ্চাতে স্বয়ং অধীরবাবু মচমচে শব্দে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে আসিয়া উপস্থিত। বেণুর মুখ বিবৰ্ণ হইয়া গেল। মা ঘরের মধ্যে সরিয়া গেলেন । অধর ছেলের সম্মুখে আসিয়া ক্ৰোধে কম্পিত কণ্ঠে হরলালের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “এই বুঝি ! রতিকান্ত আমাকে তখনই বলিয়াছিল, কিন্তু তোমার পেটে যে এত মতলব ছিল তাহা আমি বিশ্বাস করি নাই। তুমি মনে করিয়াছ বেণুকে বশ করিয়া উহার ঘাড় ভাঙিয়া খাইবে । কিন্তু সে হইতে দিব না । ছেলে চুরি করিবে ! তোমার নামে পুলিস-কেস করিব, তোমাকে জেলে ঠেলিব তবে ছাড়িব ।” এই বলিয়া বেণুর দিকে চাহিয়া কহিলেন, “চল। ওঠ ।” বেণু কোনো কথাটি না কহিয়া তাহার বাপের পিছনে পিছনে চলিয়া গেল । সেদিন কেবল হরলালের মুখেই খাবার উঠিল না। b এবারে হরলালের সদাগর-আপিস কী জানি কী কারণে মফস্বল হইতে প্রচুর পরিমাণে চাল ডাল খরিদ করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছে। এই উপলক্ষে হরলালকে প্রতি সপ্তাহেই শনিবার ভোরের গাড়িতে সাত-আট হাজার টাকা লইয়া মফস্বলে যাইতে হইত। পাইকের দিগকে হাতে হাতে দাম চুকাইয়া দিবার জন্য মফস্বলের একটা বিশেষ কেন্দ্ৰে তাহদের যে আপিস আছে সেইখানে দশ ও পাচ টাকার নোট ও নগদ টাকা লইয়া সে যাইত, সেখানে রসিদ ও খাতা দেখিয়া গত সপ্তাহের মোটা হিসাব মিলাইয়া, বর্তমান সপ্তাহের কাজ চালাইবার জন্য টাকা রাখিয়া আসিত । সঙ্গে আপিসের দুইজন দরোয়ান যাইত । হরলালের জামিন নাই বলিয়া আপিসে একটা কথা উঠিয়ছিল, কিন্তু বড়োসাহেব নিজের উপর সমস্ত কুঁকি লইয়া বলিয়াছিলেন- হরলালের জামিনের প্রয়োজন নাই । মাঘ মাস হইতে এইভাবে কাজ চলিতেছে, চৈত্র পর্যন্ত চলিবে এমন সম্ভাবনা আছে । এই ব্যাপার লইয়া হরলাল বিশেষ ব্যন্ত ছিল। প্রায়ই তাহাকে অনেক রাত্রে আপিস হইতে ফিরিতে হইত । একদিন এইরূপ রাত্রে ফিরিয়া শুনিল বেণু আসিয়ছিল, মা তাহকে খাওয়াইয়া যত্ন করিয়া । বসাইয়াছিলেন- সেদিন তাহর সঙ্গে কথাবার্তা গল্প করিয়া তাহার প্রতি ঠাহীর মন আরো জেহে वांकूठे श्वांछ । এমন আরো দুই-একদিন হইতে লাগিল । মা বলিলেন, “বাড়িতে মা নাই নাকি, সেইজন্য সেখানে তাহার মন টেকে না । আমি বেণুকে তোর ছোটো ভাইয়ের মতো, আপনি ছেলের মতোই দেখি । সেই মোহ পাইয়া আমাকে কেবল মা বলিয়া ডাকিবার জন্য এখানে আসে ।” এই বলিয়া আঁচলের প্রান্ত দিয়া তিনি চোখ মুছিলেন । হরলালের একদিন বেণুর সঙ্গে দেখা হইল। সেদিন সে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া ছিল । অনেক রাত পর্যন্ত কথাবার্তা হইল। বেণু বলিল, “বাবা আজকাল এমন হইয়া উঠিয়াছেন যে আমি কিছুতেই বাড়িতে টিকিতে পারিতেছি না। বিশেষত শুনিতে পাইতেছি, তিনি বিবাহ করিবার জন্য প্রান্তত হইতেছেন। রতিবাবু সম্বন্ধ লইয়া আসিতেছেন- তাহার সঙ্গে কেবলই পরামর্শ চলিতেছে। পূর্বে আমি কোথাও গিয়া দেরি করিলে বাবা অস্থির হইয়া উঠিতেন, এখন যদি আমি দুই-চারিদিন বাড়িতে না ফিরি। তাহা হইলে তিনি আরাম বোধ করেন । আমি বাড়ি থাকিলে বিবাহের আলোচনা সাবধানে