পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

邻阳@冈 8ዒ © উপায় কী, উপায় কী, উপায় কী- এই ভাবিতে ভাবিতে সেই রৌদ্রে হরলাল রান্তায় বেড়াইতে লাগিল । শেষে উপায় আছে কি না সে ভাবনা বন্ধ হইয়া গেল। কিন্তু বিনা কারণে পথে ঘুরিয়া বেড়ানো থামিল না । যে কলিকাতা হাজার হাজার লোকের আশ্রয়স্থান তাহাঁই এক মুহুর্তে হরলালের পক্ষে একটা প্ৰকাণ্ড ফাসকলের মতো হইয়া উঠিল । ইহার কোনো দিকে বাহির হইবার কোনো পথ নাই । সমস্ত জনসমাজ এই অতিক্ষুদ্র হরলালকে চারি দিকে আটক করিয়া দাড়াইয়াছে। কেহ তাহাকে জানেও না, এবং তাহার প্রতি কাহারও মনে কোনো বিদ্বেষও নাই, কিন্তু প্ৰত্যেক লোকেই তাহার শত্ৰু । অথচ রাস্তার লোক তাহার গা ঘেষিয়া তাহার পাশ দিয়া চলিয়াছে ; আপিসের বাবুরা বাহিরে আসিয়া ঠোঙায় করিয়া জল খাইতেছেন, তাহার দিকে কেহ তাকাইতেছেন না ; ময়দানের ধারে অলস পথিক মাথার নীচে হাত রাখিয়া একটা পায়ের উপর আর-একটা পা তুলিয়া গাছের তলায় পড়িয়া আছে : স্যাকরাগাড়ি ভরতি করিয়া হিন্দুস্থানী মেয়েরা কালীঘাটে চলিয়াছে ; একজন চাপরাসি একখানা চিঠি লইয়া হরলালের সম্মুখে ধরিয়া কহিল, “বাবু, ঠিকানা পড়িয়া দাও"- যেন তাহার সঙ্গে অনা পথিকের কোনো প্ৰভেদ নাই ; সেও ঠিকানা পড়িয়া তাহাকে বুঝাইয়া দিল । ক্রমে আপিস বন্ধ হইবার সময় আসিল । বাড়িমুখো গাড়িগুলো আপিসমহলের নানা রাস্তা দিয়া ছুটিয়া বাহির হইতে লাগিল । আপিসের বাবুরা ট্রাম ভরতি করিয়া থিয়েটারের বিজ্ঞাপন পড়িতে পড়িতে বাসায় ফিরিয়া চলিল । আজ হইতে হরলালের আপিস নাই, আপিসের ছুটি নাই, বাসায় ফিরিয়া যাইবার জন্য ট্রাম কখনো-বা অতান্ত উৎকট সত্যের মতো দাত মেলিয়া উঠিতেছে, কখনো-বা একেবারে বস্তুহীন স্বপ্নের মতো ছায়া হইয়া আসিতেছে । আহার নাই, বিশ্রাম নাই, আশ্রয় নাই, কেমন করিয়া যে হরলালের দিন কাটিয়া গেল তাহা সে জানিতেও পারিল না । রাস্তায় রাস্তায় গ্যাসের আলো জ্বলিল- যেন একটা সতর্ক অন্ধকার দিকে দিকে তাহার সহস্র ত্রুর চক্ষু মেলিয়া শিকারলুব্ধ দানবের মতো চুপ করিয়া রহিল । রাত্ৰি কত হইল সে কথা হরলাল চিন্তাও করিল না। তাহার কপালের শিরা দব দাব করিতেছে ; মাথা যেন ফাটিয়া যাইতেছে ; সমস্ত শরীরে আগুন জ্বলিতেছে ; পা আর চলে না । সমস্ত দিন পর্যায়ক্রমে বেদনার উত্তেজনা ও অবসাদের অসাড়তার মধ্যে মার কথা কেবল মনের মধ্যে যাতায়াত করিয়াছে- কলিকাতার অসংখ্য জনশ্রেণীর মধ্যে কেবল ঐ একটিমাত্র নামই শুষ্ককণ্ঠ ভেদ করিয়া মুখে উঠিয়াছে— মা, মা, মা । আর কাহাকেও ডাকিবার নাই। মনে করিল, রাত্রি যখন নিবিড় হইয়া আসিবে, কোনো লোকই যখন এই অতি সামান্য হরলালকে বিনা অপরাধে অপমান করিবার জন্য জাগিয়া থাকিবে না, তখন সে চুপ করিয়া তাহার মায়ের কোলের কাছে গিয়া শুইয়া পড়িবেতাহার পরে ঘুম যেন আর না ভাঙে ! পাছে তার মার সম্মুখে পুলিসের লোক বা আর-কেহ তাহাকে অপমান করিতে আসে এই ভয়ে সে বাসায় যাইতে পারিতেছিল না । শরীরের ভার যখন আর বহিতে পারে না। এমন সময় হরলাল একটা ভাড়াটে গাড়ি দেখিয়া তাহাকে ডাকিল । গাড়োয়ান জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইবে ।” হরলাল কহিল, “কোথাও না । এই ময়দানের রাস্তায় খানিকক্ষণ হওয়া খাইয়া বেড়াইব ।” গাড়োয়ান সন্দেহ করিয়া চলিয়া যাইবার উপক্ৰম করিতেই হরলাল তাহার হাতে আগাম ভাড়া একটা টাকা দিল । সে গাড়ি তখন হরলালকে লইয়া ময়দানের রাস্তায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে ठनठिन । তখন শ্ৰান্ত হরলাল তাহার তপ্ত মাথা খোলা জানলার উপর রাখিয়া চোখ বুজিল। একটু একটু করিয়া তাহার সমস্ত বেদনা যেন দূর হইয়া আসিল । শরীর শীতল হইল। মনের মধ্যে একটি সুগভীর সুনিবিড় আনন্দপূর্ণ শান্তি ঘনাইয়া আসিতে লাগিল। একটা যেন পরম পরিত্রাণ তাহাকে চারি দিক হইতে আলিঙ্গন করিয়া ধরিল । সে যে সমান্তদিন মনে করিয়াছিল কোথাও তাহার কোনো পথ নাই, সহায় নাই, নিকৃতি নাই, তাহার অপমানের শেষ নাই, দুঃখের অবধি নাই, সে কথাটা যেন এক মুহুর্তেই মিথ্যা হইয়া গেল । এখন মনে হইল, সে তো একটা ভয় মাত্র, সে তো সত্য নয় । যাহা তাহার