পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

few 8br○ তাহার সেই ডাক সুরঙ্গের সমন্ত শাখাপ্রশাখা হইতে বারংবার প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। অনতিদূর হইতে উত্তর আসিল, “আমি তোমার নিকটেই আছি- কী চাও বলে ।” মৃত্যুজয় কাতরম্বরে কহিল, “কোথায় ধন আছে আমাকে দয়া করিয়া দেখাইয়া দাও।” . তখন আর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। মৃত্যুজয় বারংবার ডাকিল, কোনো সাড়া পাইল না । দণ্ডপ্রহরের দ্বারা অবিভক্ত এই ভূতলগত চিররাত্রির মধ্যে মৃত্যুজয় আর-একবার ঘুমাইয়া লইল । ঘুম হইতে আবার সেই অন্ধকারের মধ্যে জাগিয়া উঠিল। চিৎকার করিয়া ডাকিল, “ওগো, আহুকি ৷” নিকট হইতেই উত্তর পাইল, “এইখানেই আছি । কী চাও ।” মৃত্যুজয় কহিল, “আমি আর-কিছু চাই না- আমাকে এই সুরঙ্গ হইতে উদ্ধার করিয়া লইয়া या9 !” সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি ধন চাও না ?” মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “না, চাহি না ।” তখন চকমকি ঠোকার শব্দ উঠিল এবং কিছুক্ষণ পরে আলো জ্বলিল । সন্ন্যাসী কহিলেন, “তবে এসো মৃত্যুজয়, এই সুরঙ্গ হইতে বাহিরে যাই ।” মৃত্যুঞ্জয় কাতরস্বরে কহিল, “বাবা, নিতান্তই কি সমন্ত ব্যর্থ হইবে। এত কষ্ট্রের পরেও ধন কি পাইব नां ।” তৎক্ষণাৎ মশাল নিবিয়া গেল। মৃত্যুজয় কহিল, “কী নিষ্ঠুর।” বলিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িয়া ভাবিতে লাগিল । সময়ের কোনো পরিমাণ নাই, অন্ধকারের কোনো অন্ত নাই । মৃত্যজয়ের ইচ্ছা! করিতে লাগিল তাহার সমস্ত শরীর-মনের বলে এই অন্ধকারটাকে ভাঙিয়া চূৰ্ণ করিয়া ফেলে। আলোক আকাশ আর বিশ্বচ্ছবির বৈচিত্র্যের জন্য তাহার প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠিল, কহিল, “ওগো সন্ন্যাসী, ওগো নিষ্ঠুর সন্ন্যাসী, আমি ধন চাই না, আমাকে উদ্ধার করো।” সন্ন্যাসী কহিলেন, “ধন চাও না ? তবে আমার হাত ধরে । আমার সঙ্গে চলো ।” এবারে আর আলো জ্বলিল না। এক হাতে যষ্টি ও এক হাতে সন্ন্যাসীর উত্তরীয় ধরিয়া মৃত্যুজয় ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল । বহুক্ষণ ধরিয়া অনেক আঁকাবঁকা পথ দিয়া অনেক ঘুরিয়া ফিরিয়া এক জায়গায় আসিয়া সন্ন্যাসী কহিলেন, “দাড়াও ।” মৃত্যুজয় দাড়াইল । তাহার পরে একটা মরিচা-পড়া লোহার দ্বার খোলার উৎকট শব্দ শোনা গেল । সন্ন্যাসী মৃত্যুঞ্জয়ের হাত ধরিয়া কহিলেন, “এসো।” মৃত্যুজয় অগ্রসর হইয়া যেন একটা ঘরে প্রবেশ করিল। তখন আবার চকমকি ঠোকার শব্দ শোনা গেল। কিছুক্ষণ পরে যখন মশাল জ্বলিয়া উঠিল তখন, এ কী আশ্চর্য দৃশ্য ! চারি দিকে দেয়ালের গায়ে মোটা মোটা সোনার পাত ভূগর্ভরুদ্ধ কঠিন সূর্যালোকপূজের মতো স্তরে স্তরে সজ্জিত । মৃত্যুজয়ের চোখ দুটা জ্বলিতে লাগিল। সে পাগলের মতো বলিয়া উঠিল, “এ সোনা আমার- এ আমি কোনোমতেই ফেলিয়া যাইতে পারিব না ।” সন্ন্যাসী কহিলেন, “আচ্ছা, ফেলিয়া যাইয়ো না ; এই মশাল রহিল- আর এই ছাতু, চিড়া আর বড়ো এক ঘটি জল রাখিয়া গেলাম।” দেখিতে দেখিতে সন্ন্যাসী বাহির হইয়া আসিলেন, আর এই স্বৰ্ণভাণ্ডারের লৌহজারে কপাট পড়িল । মৃত্যুঞ্জয় বার বার করিয়া এই স্বর্ণপুঞ্জ স্পর্শ করিয়া ঘরময় ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। ছোটাে আর-একটা আঘাত করিয়া শব্দ করিতে লাগিল, সর্বাঙ্গের উপর বুলাইয়া তাহার স্পর্শ লাইতে লাগিল । অবশেষে শ্ৰান্ত হইয়া সোনার পাত বিছাইয়া তাহার উপর শয়ন করিয়া ঘুমাইয়া পড়িল । জাগিয়া উঠিয়া দেখিল, চারি দিকে সোনা ঝকমক করিতেছে। সোনা ছাড়া আর-কিছুই নাই । মৃত্যুজয় ভাবিতে লাগিল, পৃথিবীর উপরে হয়তো এতক্ষণে প্রভাত হইয়াছে, সমন্ত জীবজন্তু আনন্দে