পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8br8 রবীন্দ্র-রচনাবলী জাগিয়া উঠিয়াছে।- তাহাদের বাড়িতে পুকুরের ধারের বাগান হইতে প্ৰভাতে যে একটি জিপ্ত গন্ধ উঠিত তাহাই কল্পনায় তাহার নাসিকায় যেন প্ৰবেশ করিতে লাগিল । সে যেন স্পষ্ট চোখে দেখিতে পাইল, পাতিহাসগুলি দুলিতে দুলিতে কলরব করিতে করিতে সকালবেলায় পুকুরের জলের মধ্যে আসিয়া পড়িতেছে, আর বাডির ঝি বামা কোমরে কাপড় জড়াইয়া উধের্ধাখিত দক্ষিণহস্তের উপর একরাশি পিতলৰ্কাসার থালা বাটি লইয়া ঘাটে আনিয়া উপস্থিত করিতেছে। মৃত্যুঞ্জয় দ্বারে আঘাত করিয়া ডাকিতে লাগিল, “ওগো সন্ন্যাসীঠাকুর, আছ কি ৷” দ্বার খুলিয়া গেল। সন্ন্যাসী কহিলেন, “কী চাও।” মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “আমি বাহিরে যাইতে চাই- কিন্তু সঙ্গে এই সোনার দুটাে-একটা পাতও কি व्लेशा शाश्ठ °ालित ना ।” সন্ন্যাসী তাহার কোনো উত্তর না দিয়া নৃতন মশাল জ্বালাইলেন- পূৰ্ণ কমণ্ডলু একটি রাখিলেন আর উত্তরীয় হইতে কয়েক মুষ্টি চিড়া মেজের উপর রাখিয়া বাহির হইয়া গেলেন । দ্বার বন্ধ হইয়া গেল । মৃত্যুঞ্জয় পাতলা একটা সোনার পাত লইয়া তাহা দোমড়াইয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া ভাঙিয়া ফেলিল । সেই খণ্ড সোনাগুলাকে লইয়া ঘরের চারি দিকে লোষ্ট্রখণ্ডের মতো ছড়াইতে লাগিল । কখনো বা দাত দিয়া দংশন করিয়া সোনার পাতের উপর দাগ করিয়া দিল । কখনো বা একটা সোনার পাত মাটিতে ফেলিয়া তাহার উপরে বারংবার পদাঘাত করিতে লাগিল। মনে মনে বলিতে লাগিল, পৃথিবীতে এমন সম্রাট কয়জন আছে যাহারা সোনা লইয়া এমন করিয়া ফেলাছড়া করিতে পারে । মৃত্যুঞ্জয়ের যেন একটা প্রলয়ের রেখ চাপিয়া গেল। তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল, এই রাশীকৃত সোনাকে চূৰ্ণ করিয়া ধূলির মতো সে বঁটা দিয়া ঝাট দিয়া উড়াইয়া ফেলে- আর এইরূপে পৃথিবীর সমস্ত সুবৰ্ণলুব্ধ রাজা-মহারাজকে সে অবজ্ঞা করিতে পারে । এমনি করিয়া যতক্ষণ পারিল মৃত্যুঞ্জয় সোনাগুলাকে লইয়া টানাটানি করিয়া শ্ৰান্তদেহে ঘুমাইয়া পড়িল । ঘুম হইতে উঠিয়া সে আবার তাহার চারি দিকে সেই সোনার তৃপ দেখিতে লাগিল । সে তখন দ্বারে আঘাত করিয়া চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “ওগো সন্ন্যাসী, আমি এ সোনা চাই না(नाना फाटे मां !” কিন্তু দ্বার খুলিল না । ডাকিতে ডাকিতে মৃত্যুঞ্জয়ের গলা ভাঙিয়া গেল, কিন্তু দ্বার খুলিল না— এক-একটা সোনার পিণ্ড লইয়া দ্বারের উপর ছুড়িয়া মারিতে লাগিল, কোনো ফল হইল না । মৃত্যুঞ্জয়ের বুক দমিয়া গেল— তবে আর কি সন্ন্যাসী আসিবে না । এই স্বর্ণকারাগারের মধ্যে তিলে তিলে পলে পলে শুকাইয়া মরিতে হইবে । তখন সোনাগুলোকে দেখিয়া তাহার আতঙ্ক হইতে লাগিল । বিভীষিকার নিঃশব্দ কঠিন হাস্যের মতো ঐ সোনার স্তৃপ চারি দিকে স্থির হইয়া রহিয়াছে— তাহার মধ্যে স্পন্দন নাই, পরিবর্তন নাইমৃত্যুঞ্জয়ের যে হৃদয় এখন কঁাপিতেছে, ব্যাকুল হইতেছে, তাহার সঙ্গে উহাদের কোনো সম্পর্ক নাই, বেদনার কোনো সম্বন্ধ নাই । এই সোনার পিণ্ডগুলা আলোক চায় না, আকাশ চায় না, বাতাস চায় না, প্ৰাণ চায় না, মুক্তি চায় না । ইহারা এই চির-অন্ধকারের মধ্যে চিরদিন উজ্জ্বল হইয়া কঠিন হইয়া স্থির হইয়া রহিয়াছে । পৃথিবীতে এখন কি গোধূলি আসিয়াছে । আহা, সেই গোধূলির স্বর্ণ ! যে স্বৰ্ণ কেবল ক্ষণকালের জন্য চোখ জুড়াইয়া অন্ধকারের প্রান্তে কঁাদিয়া বিদায় লইয়া যায় । তাহার পরে কুটিরের প্রাঙ্গণতলে সন্ধাতারা একদৃষ্টি চাহিয়া থাকে । গোষ্ঠে প্ৰদীপ জ্বালাইয়া বধু ঘরের কোণে সন্ধ্যাদীপ স্থাপন করে। মন্দিরে আরতির ঘণ্টা বাজিয়া উঠে । গ্রামের ঘরের অতি ক্ষুদ্রতম তুচ্ছতম ব্যাপার আজ মৃত্যুঞ্জয়ের কল্পনা দৃষ্টির কাছে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল । তাহদের সেই- যে ভোলা কুকুরটা লেজে মাথায় এক হইয়া উঠানের প্রান্তে সন্ধ্যার পর ঘুমাইতে থাকিত, সে কল্পনাও তাহাকে যেন ব্যথিত করিতে লাগিল । ধারাগোল গ্রামে কয়দিন সে যে