পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓisiq}om · · 8brዓ বংশের সম্মানহানি এবং আত্মীয়দের মনোবেদনায় তারাপদকে যখন কিছুমাত্র বিচলিত করিতে পারিল না। তখন কেমন করিয়া বিষয় বিভাগ হইতে পারে সেই অসাধ্য চিন্তায় ভবানীকে প্রবৃত্ত হইতে হইল। তারাপদ ঠাহার চিন্তা দেখিয়া অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “খুড়ামহাশয়, কাণ্ড কী । আপনি এত ভাবিতেছেন কেন । বিষয় ভাগ তো হইয়াই আছে । ঠাকুরদাদা বাচিয়া থাকিতেই তো ভাগ করিয়া দিয়া গেছেন ।” ভবানী হতবুদ্ধি হইয়া কহিলেন, “সত্য নাকি । আমি তো তাহার কিছুই জানি না।” তারাপদ কহিলেন, “বিলক্ষণ ! জানেন না তো কী । দেশসূদ্ধ লোক জানে, পাছে আপনাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিবাদ ঘটে এইজন্য আলন্দি তালুক আপনাদের অংশে লিখিয়া দিয়া ঠাকুরদাদা প্ৰথম হইতেই আপনাদিগকে পৃথক করিয়া দিয়াছেন- সেই ভাবেই তো এ পর্যন্ত চলিয়া আসিতেছে।” ভবানীচরণ ভাবিলেন, সকলই সম্ভব। জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই বাড়ি ?” তারাপদ কহিলেন, “ইচ্ছে করেন তো বাড়ি আপনারাই রাখিতে পারেন। সদর মহকুমায় যে কুঠি আছে সেইটে পাইলেই আমাদের কোনোরকম করিয়া চলিয়া যাইবে ।” । তারাপদ এত অনায়াসে পৈতৃক বাড়ি ছাড়িতে প্ৰস্তুত হইলেন দেখিয়া তাহার ঔদার্যে তিনি বিস্মিত হইয়া গেলেন। তাঁহাদের সদর মহকুমার বাড়ি তিনি কোনােদিন দেখেন নাই এবং তাহার প্রতি তাহার কিছুমাত্র মমতা ছিল না । ভবানী যখন তাহার মাতা ব্রজসুন্দরীকে সকল বৃত্তান্ত জানাইলেন, তিনি কপালে করাঘাত করিয়া বলিলেন, “ওমা, সে কী কথা। আলন্দি তালুক তো আমার খোরপোষের জন্য আমি শ্ৰীধনস্বরূপে পাইয়াছিলাম- তাহার আয়ও তো তেমন বেশি নয়। পৈতৃক সম্পত্তিতে তোমার যে অংশ সে তুমি পাইবে না কেন ।” ভবানী কহিলেন, “তারাপদ বলে, পিতা আমাদিগকে ঐ তালুক ছাড়া আর-কিছু দেন নাই।” ব্রজসুন্দরী কহিলেন, “সে কথা বলিলে আমি শুনিব কেন । কর্তা নিজের হাতে র্তাহার উইল দুই প্রন্থ লিখিয়াছিলেন- তাহার এক প্রস্ত আমার কাছে রাখিয়াছেন ; সে আমার সিন্দুকেই আছে।” সিন্দুক খোলা হইল। সেখানে আলন্দি তালুকের দানপত্র আছে কিন্তু উইল নাই। উইল চুরি first পরামর্শদাতাকে ডাকা হইল। লোকটি তাঁহাদের গুরুঠাকুরের ছেলে । নাম বগলাচরণ। সকলেই বলে তাহার ভারি পাকা বুদ্ধি । তাহার বাপ গ্রামের মন্ত্ৰদাতা আর ছেলেটি মন্ত্রণাদাতা। পিতাপুত্রে গ্রামের পরকাল ইহকাল ভাগাভাগি করিয়া লইয়াছে। অন্যের পক্ষে তাহার ফলাফল যেমনই হউক, তাহাদের নিজেদের পক্ষে কোনো অসুবিধা ঘটে নাই । বগলাচরণ কহিল, “উইল না-ই পাওয়া গেল। পিতার সম্পত্তিতে দুই ভায়ের তো সমান অংশ থাকিবেই।” এমন সময় অপর পক্ষ হইতে একটা উইল বাহির হইল। তাহাতে ভবানীচরণের অংশে কিছুই লেখে না । সমস্ত সম্পত্তি পৌত্রদিগকে দেওয়া হইয়াছে। তখন অভয়াচরণের পুত্র জন্মে নাই। বগলাকে কাণ্ডায়ী করিয়া ভবানী মকদ্দমার মহাসমুদ্রে পাড়ি দিলেন । বন্দরে আসিয়া লোহার সিন্দুকটি যখন পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন তখন দেখিতে পাইলেন, লক্ষ্মীপেঁচার বাসটি একেবারে শূন্য-সামান্য দুটাে-একটা সোনার পালক খসিয়া পড়িয়া আছে। পৈতৃক সম্পত্তি অপরপক্ষের হাতে গেল। আর আলন্দি তালুকের যে ডগািটুকু মকদ্দমা-খরচার বিনাশীতল হইতে জাগিয়া রহিল, কোনোমতে তাহাকে আশ্রয় করিয়া থাকা চলে মাত্র কিন্তু বংশমর্যাদা রক্ষা করা চলে না। পুরাতন বাড়িটা ভবানীচরণ পাইয়া মনে করিলেন ভারি জিতিয়াছি। তারাপদর দল সদরে চলিয়া গেল। উভয়পক্ষের মধ্যে আর দেখাসাক্ষাৎ রহিল না ।