পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8bry রবীন্দ্র-রচনাবলী ܓ শ্যামাচরণের বিশ্বাসঘাতকতা ব্রজসুন্দরীকে শেলের মতো বাজিল । শ্যামাচরণ অন্যায় করিয়া কর্তার উইল চুরি করিয়া ভাইকে বঞ্চিত করিল এবং পিতার বিশ্বাসভঙ্গ করিল ইহা তিনি কোনোমতেই ভুলিতে পারিলেন না। তিনি যতদিন বাচিয়া ছিলেন প্রতিদিনই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বার বার করিয়া বলিতেন, ‘ধর্মে ইহা কখনোই সহিবে না ।' ভবানীচরণকে প্রায়ই প্রতিদিন তিনি এই বলিয়া আশ্বাস দিয়াছেন যে, “আমি আইন-আদালত কিছুই বুঝি না, আমি তোমাকে বলিতেছি, কর্তার সে উইল কখনোই চিরদিন চাপা থাকিবে না । সে তুমি নিশ্চয়ই ফিরিয়া পাইবে।” বরাবর মাতার কাছে এই কথা শুনিয়া ভবানীচরণ মনে অত্যন্ত একটা ভরসা পাইলেন । তিনি নিজে অক্ষম বলিয়া এইরূপ আশ্বাসবােক্য তাহার পক্ষে অত্যন্ত সান্তনার জিনিস । সতীসাধনীর বাক্য ফলিবেই, যাহা তাহারই তাহা আপনিই তাহার কাছে ফিরিয়া আসিবে এ কথা তিনি নিশ্চয় স্থির করিয়া বসিয়া রহিলেন । মাতার মৃত্যুর পরে এ বিশ্বাস তাহার আরো দৃঢ় হইয়া উঠিল- কারণ মৃত্যুর বিচ্ছেদের মধ্য দিয়া মাতার পুণ্যতেজ তাহার কাছে আরো অনেক বড়ো করিয়া প্রতিভাত হইল। দারিদ্র্যের সমস্ত অভাব্যপীড়ন যেন তাহার গায়েই বাজিত না । মনে হইত, এই-যে অন্নবক্সের কষ্ট, এই-যে পূর্বেকার চালচলনের ব্যত্যয়, এ যেন দুদিনের একটা অভিনয়মাত্র- এ কিছুই সত্য নহে ! এইজন্য সাবেক ঢাকাই ধুতি ছিডিয়া গেলে যখন কম দামের মোটা ধুতি তাহাকে কিনিয়া পরিতে হইল তখন তাহার হাসি পাইল । পূজার সময় সাবেক কালের ধুমধাম চলিল না, নমোনম করিয়া কােজ সারিতে হইল । অভ্যাগতজন এই দরিদ্র আয়োজন দেখিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সাবেক কালের কথা পাড়িল । ভবানীচরণ মনে মনে হাসিলেন ; তিনি ভাবিলেন, ইহারা জানে না। এ-সমস্তই কেবল কিছুদিনের জন্য- তাহার পর এমন ধুম করিয়া একদিন পূজা হইবে যে, ইহাদের চক্ষুস্থির হইয়া যাইবে । সেই ভবিষ্যতের নিশ্চিত সমারোহ তিনি এমনি প্রত্যক্ষের মতো দেখিতে পাইতেন যে, বর্তমান দৈন্য র্তাহার চোখেই পড়িত না । এ সম্বন্ধে তাহার আলোচনা করিবার প্রধান মানুষটি ছিল নোটাে চাকর । কতবার পূজোৎসবের দারিদ্র্যের মাঝখানে বসিয়া প্ৰভু-ভূত্যে, ভাবী সুদিনে কিরূপ আয়োজন করিতে হইবে তাহারই বিস্তারিত আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন । এমন-কি, কাহাকে নিমন্ত্ৰণ করিতে হইবে না-হইবে এবং কলিকাতা হইতে যাত্রার দল আনিবার প্রয়োজন আছে কি না তাহা লইয়া উভয়পক্ষে ঘোরতর মতান্তর ও তর্কবিতর্ক হইয়া গিয়াছে। স্বভাবসিদ্ধ অনীেদাৰ্যবশত নাটবিহারী সেই ভাবীকালের ফার্স-রচনায় কৃপণতা প্ৰকাশ করায় ভবানীচরণের নিকট হইতে তীব্র ভৎসনা লাভ করিয়াছে। এরূপ ঘটনা প্রায়ই ঘটিত । মোটের উপরে বিষয়সম্পত্তি সম্বন্ধে ভবানীচরণের মনে কোনোপ্রকার দুশ্চিন্তা ছিল না । কেবল তাহার একটিমাত্র উদবেগের কারণ ছিল, কে তাহার বিষয় ভোগ করবে। আজ পর্যন্ত তাহার সন্তান হইল না । কন্যাদায়গ্ৰন্ত হিতৈষীরা যখন তাহাকে আর-একটি বিবাহ করিতে অনুরোধ করিত তখন তাহার মন এক-একবার চঞ্চল হইত ; তাহার কারণ এ নয় যে নববধূ সম্বন্ধে ঠাহার বিশেষ শখ ছিল- বরঞ্চ সেবক ও অল্পের ন্যায় স্ত্রীকেও পুরাতনভাবেই তিনি প্রশান্ত বলিয়া গণ্য করিতেন- কিন্তু যাহার ঐশ্বৰ্যসম্ভাবনা আছে তাহার সন্তানসম্ভাবনা না থাকা বিষম বিড়ম্বনা বলিয়াই তিনি জানিতেন । এমন সময় যখন তাহার পুত্র জম্মিল তখন সকলেই বলিল, এইবার এই ঘরের ভাগ্য ফিরিবে, তাহার সূত্রপাত হইয়াছে। স্বয়ং স্বগীয় কর্তী অভয়চরণ আবার এ ঘরে জন্মিয়াছেন, ঠিক সেই রকমেরই টানা চোখ। ছেলের কোষ্ঠীতেও দেখা গেল, গ্রহে নক্ষত্রে এমনিভাবে যোগাযোগ ঘটিয়াছে যে হৃতসম্পত্তি উদ্ধার না হইয়া যায় না । ছেলে হওয়ার পর হইতে ভবানীচরণের ব্যবহারে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। এতদিন পর্যন্ত দারিদ্র্যাকে তিনি নিতান্তই একটা খেলার মতো সকীেতুকে অতি অনায়াসেই বহন করিয়াছিলেন, কিন্তু