পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓisiq፡ጂ 8vo) না। নিশ্বাস ফেলিয়া মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে ভবানীচরণ বাহিরে চলিয়া আসিলেন। একলা ঘরের দাওয়ায় বসিয়া খুব কবিয়া তামাক খাইতে লাগিলেন । পঞ্চমীর দিনে তাহার পাতে দই পায়স অমনি পড়িয়া রহিল। সন্ধ্যাবেলায় শুধু একটা সন্দেশ খাইয়াই জল খাইলেন, লুচি (ইতে পারিলেন না। বলিলেন, “ক্ষুধা একেবারেই নাই।” এবার দুর্গপ্রাচীরে মন্ত একটা ছিদ্র দেখা দিল। ষষ্ঠীর দিনে রাসমণি স্বয়ং কালীপদকে নিভৃতে। ডাকিয়া লইয়া তাহার আদরের ডাকনাম ধরিয়া বলিলেন, “ভেঁটুি, তোমার এত বয়স হইয়াছে, তবু তোমার অন্যায় আবদার ঘুচিল না ! ছিঃ ছিঃ ! যেটা পাইবার উপায় নাই সেটাকে লোভ করিলে অর্ধেক চুরি করা হয় তা জান !” কালীপদ নাকীসুরে কহিল, “আমি কী জানি । বাবা যে বলিয়াছেন, ওটা আমাকে দেবেন।” তখন বাবার বলার অর্থ কী রাসমণি তাহা কালীপদকে বুঝাইতে বসিলেন । পিতার এই বলার মধ্যে যে কত স্নেহ কত বেদনা, অথচ এই জিনিসটা দিতে হইলে তাহদের দরিদ্রািঘরের কত ক্ষতি কত দুঃখ তাহা অনেক করিয়া বলিলেন । রাসমণি এমন করিয়া কোনোদিন কালীপদকে কিছু বুঝান নাই- তিনি যাহা করিতেন, খুব সংক্ষেপে এবং জোরের সঙ্গেই করিতেন- কোনো আদেশকে নরম করিয়া তুলিবার আবশ্যকই তাহার ছিল না। সেইজন্য কালীপদকে তিনি যে আজ এমনি মিনতি করিয়া এত বিস্তারিত করিয়া কথা বলতেছেন তাহতে সে আশ্চৰ্য হইয়া গেল, এবং মাতার মনের এক জায়গায় যে কতটা দরদ আছে বালক হইয়াও একরকম করিয়া সে তাহা বুঝিতে পারিল । কিন্তু মেমের দিক হইতে মন এক মুহুর্তে ফিরাইয়া আনা কত কঠিন তাহা বয়স্ক পাঠকদের বুঝিতে কষ্ট হইবে না । তাই কালীপদ মুখ অত্যন্ত গভীর করিয়া একটা কাঠি লইয়া মাটিতে আঁচড় কাটিতে লাগিল । তখন রাসমণি আবার কঠিন হইয়া উঠিলেন- কঠোরস্বরে কহিলেন, “তুমি রাগই কর আর কান্নাকাটিই কর, যাহা পাইবার নয় তাহা কোনোমতেই পাইবে না ।” এই বলিয়া আর বৃথা সময় নষ্ট না করিয়া দ্রুতপদে গৃহকর্মে চলিয়া গেলেন । কালীপদ বাহিরে গেল। তখন ভবানীচরণ একলা বসিয়া তামাক খাইতেছিলেন। দূর হইতে কালীপদকে দেখিয়াই তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া যেন একটা বিশেষ কাজ আছে এমনি ভাবে কোথায় চলিলেন । কালীপদ চুটিয়া আসিয়া কহিল, “বাবা, আমার সেই মেম-” আজ আর ভবানীচরণের মুখে হাসি বাহির হইল না ; কালীপদার গলা জড়াইয়া ধরিয়া কহিলেন, * রোস বাবা, আমার একটা কাজ আছে- সেরে আসি, তার পরে সব কথা হবে ।” বলিয়া তিনি বাড়ির বাহির হইয়া পড়িলেন । কালীপদর মনে হইল, তিনি যেন তাড়াতাড়ি চোখ হইতে জল মুছিয়া ফেলিলেন । তখন পাড়ার এক বাড়িতে পরীক্ষা করিয়া উৎসবের বাশির বায়না করা হইতেছিল। সেই রসনচৌকিতে সকালবেলাকার করুণাসুরে শরতের নবীন রৌদ্র যেন প্রচ্ছন্ন অশ্রুভারে ব্যথিত হইয়া উঠিতেছিল। কালীপদ তাহদের বাড়ির দরজার কাছে দাড়াইয়া চুপ করিয়া পথের দিকে চাহিয়া রহিল । তাহার পিতা যে কোনো কাজেই কোথাও যাইতেছেন না, তাহা তাহার গতি দেখিয়াই বুঝা যায়- প্ৰতি পদক্ষেপেই তিনি যে একটা নৈরাশ্যের বোঝা টানিয়া টানিয়া চলিয়াছেন এবং তাহা কোথাও ফেলিবার স্থান নাই, তাহা তাহার পশ্চাৎ হইতেও স্পষ্ট দেখা যাইতেছিল । কালীপদ অন্তঃপুরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “মা, আমার সেই পাখা-করা মেম চাই না।” মা তখন জাতি লইয়া ক্ষিপ্ৰহন্তে সুপারি। কাটিতেছিলেন । তাহার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল । ছেলেতে মায়েতে সেইখানে বসিয়া কী একটা পরামর্শ হইয়া গেল তাহ কেহই জানিতে পারিল না । জাতি রাখিয়া ধামা-ভরা কাটা ও আকাটা সুপুরি ফেলিয়া রাসমণি তখনই বগলাচরণের বাড়ি চলিয়া (რlück | আজ ভবানীচরণের বাড়ি ফিরিতে অনেক বেলা হইল। স্নান সারিয়া যখন তিনি খাইতে বসিলেন তখন তাহার মুখ দেখিয়া বোধ হইল। আজও দধি-পায়সের সদগতি হইবে না, এমন-কি, মাছের মুড়াটা