পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8abr রবীন্দ্ৰ-রচনাৱলী করিত এবং জনশূন্য ঘরে পড়িয়া মাতাকে ডাকিত ও পিতাকে স্মরণ করিত। দারিদ্র্যের অপমান ও দুঃখ এইরূপে যতই সে ভোগ করিত ততই ইহার বন্ধন হইতে তাহার পিতামাতাকে মুক্ত করিবেই, এই প্ৰতিজ্ঞা তাহার মনে কেবলই দৃঢ় হইয়া উঠিত । কালীপদ নিজেকে অত্যন্ত সংকুচিত করিয়া সকলের লক্ষ্য হইতে সরাইয়া রাখিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু তাহাতে উৎপাত কিছুমাত্র কমিল না । কোনোদিন বা সে দেখিল, তাহার চিনাবাজারের পুরাতন সন্তা জুতার একপাটির পরিবর্তে একটি অতি উত্তম বিলাতি জুতার পাটি। এরূপ বিসদৃশ জুতা পরিয়া কলেজে যাওয়াই অসম্ভব। সে এ সম্বন্ধে কোনো নালিশ না করিয়া পরের জুতার পাটি ঘরের বাহিরে রাখিয়া দিল এবং জুতা-মেরামতওয়ালা মুচির নিকট হইতে অল্প দামের পুরাতন জুতা কিনিয়া কাজ চালাইতে লাগিল । একদিন উপর হইতে একজন ছেলে হঠাৎ কালীপদার ঘরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি ভুলিয়া আমার ঘর হইতে আমার সিগারেটের কেন্সটা লইয়া আসিয়াছেন। আমি কোথাও খুজিয়া পাইতেছি না।” কালীপদ বিরক্ত হইয়া বলিল, “আমি আপনাদের ঘরে যাই নাই।” “এই যে, এইখানেই আছে” বলিয়া সেই লোকটি ঘরের এক কোণ হইতে মূল্যবান একটি সিগারেটের কেস তুলিয়া লইয়া আর কিছু না বলিয়া উপরে চলিয়া গেল । কালীপদ মনে মনে স্থির করিল, “এফ. এ. পরীক্ষায় যদি ভালোর কম বৃত্তি পাই তবে এই মেস ছাড়িয়া চলিয়া যাইব ।” মেসের ছেলেরা মিলিয়া প্রতিবৎসর ধুম করিয়া সরস্বতীপূজা করে । তাহার ব্যয়ের প্রধান অংশ শৈলেন বহন করে। কিন্তু সকল ছেলেই ট্যাদা দিয়া থাকে । গত বৎসর নিতান্তই অবজা করিয়া কালীপদার কাছে কেহ টাদা চাহিতেও আসে নাই । এ বৎসর কেবল তাহকে বিরক্ত করিবার জন্যই তাহার নিকট চাদার খাতা আনিয়া ধরিল । যে দলের নিকট হইতে কোনোদিন কালীপদ কিছুমাত্র সাহায্য লয় নাই, যাহাদের প্রায় নিত্য-অনুষ্ঠিত আমোদপ্রমোদে যোগ দিবার সৌভাগ্য সে একেবারে অস্বীকার করিয়াছে, তাহারা যখন কালীপদার কাছে টাদার সাহায্য চাহিতে আসিল তখন জানি না সে কী মনে করিয়া পাচটা টাকা দিয়া ফেলিল। পাচ টাকা। শৈলেন তাহার দলের লোক কাহারও নিকট श्ठ eाम्र नाथ् । কালীপদার দারিদ্র্যের কৃপণতায় এ পর্যন্ত সকলেই তাহাকে অবজ্ঞা করিয়া আসিয়াছে, কিন্তু আজ তাহার এই পাঁচ টাকা দান তাহদের একেবারে অসহ্য হইল। উহার অবস্থা যে কিরূপ তাহা তো আমাদের অগোচর নাই। তবে উহার এত বড়াই কিসের । ও যে দেখি সকলকে টোকা দিতে চায় ।” সরস্বতীপূজা ধুম করিয়া হইল- কালীপদ যে পাঁচটা টাকা দিয়াছিল তাহা না দিলেও কোনো ইতারবিশেষ হইত না । কিন্তু কালীপদার পক্ষে সে কথা বলা চলে না। পরের বাড়িতে তাহাকে খাইতে হইত- সকল দিন সময়মত আহার জুটিত না । তা ছাড়া পাকশালার ভূত্যরাই তাহার ভাগ্যবিধাতা, সুতরাং ভালোমন্দ কমিবেশি সম্বন্ধে কোনো অপ্রিয় সমালোচনা না করিয়া জলখাবারের জন্য কিছু সম্বল তাহাকে হাতে রাখিতেই হইত। সেই সংগতিটুকু গাদ্দাফুলের শুষ্ক ভূপের সঙ্গে বিসর্জিত দেবীপ্রতিমার পশ্চাতে অন্তর্ধন করিল। কালীপদার মাথাধরার উৎপাত বাড়িয়া উঠিল। এবার পরীক্ষায় সে ফেল করিল না বটে। কিন্তু বৃত্তি পাইল না। কাজেই পড়িবার সময় সংকোচ করিয়া তাহকে আরো একটি টুইশনির জোগাড় করিয়া লাইতে হইল। এবং বিস্তর উপদ্রব সত্ত্বেও বিনা ভাড়ার বাসাটুকু ছাড়িতে পারিল না। উপরিতলবাসীরা আশা করিয়ছিল এবার দুটির পরে নিশ্চয়ই কালীপদ এ মেসে আর আসিবে না। কিন্তু যথাসময়েই তাহার সেই নীচের ঘরটার তালা খুলিয়া গেল। ধুতির উপর সেই তাহার চিরকেলে চেককাটা চায়নাকোট পরিয়া কালীপদ কোটরের মধ্যে প্রবেশ করিল, এবং একটা ময়লা কাপড়ে ধাধা। মন্ত পুঁটুলি -সমেত টিনের বাক্স নামাইয়া রাখিয়া শেয়ালদহের মুটে তাহার ঘরের সম্মুখে উবু হইয়া বসিয়া অনেক বাদ-প্রতিবাদ করিয়া ভাড়া চুকাইয়া লইল । ঐ পুঁটুলিটার গর্ভে নানা ইড়ি ঘুরি ভণ্ডের মধ্যে কালীপদার ময় কাচা আমি কুল চালতা প্রভৃতি উপকরলে নানাপ্রকার মুখরোচক পদাৰ্থ তৈরি